সাকা চৌধুরী ও ওবায়দুল কাদের জামিনে মুক্ত। ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম লিয়াকতও বেরিয়েএলেন নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি রাজধানীর একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীও ছাড়া পেয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল শুক্রবার জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। একইভাবে শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী ও যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা লিয়াকত হোসেনও ছাড়া পেয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার তিনি কারাগার থেকে বের হন। তাঁকে ধরিয়ে দিতে সরকার এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।
কারা সুত্র জানায়, গতকাল বেলা ১১টার দিকে কাশিমপুর কারাগার থেকে সাকা চৌধুরী এবং সকাল ১০টার দিকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেল থেকে ওবায়দুল কাদেরকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে মুক্তি পেয়ে তিনি বাসায় না গিয়ে হাসপাতালেই আছেন।
দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি এবার সরকারের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদেরও জামিনে ছাড়া পাওয়ার ঘটনায় জনমনে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক−সুজনের সভাপতি ও টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের মতে, এই সরকারের শুরুতে দুর্নীতি দমনের বিষয়ে মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল। এখন এসব ঘটনার কারণে তা দুরাশায় পরিণত হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এত বিস্তৃত করে সরকার ভুল করেছে। তারা যদি দুদককে অনুসরণ করে রুই-কাতলাদের টার্গেট করত, তাহলে বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে ফেলতে পারত।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো বিচারের পর্যায়ে নিয়ে শেষ করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সরকার।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার নিজেই বলেছে, খালেদা জিয়া আবেদন করলে জামিন পাবেন। অর্থাৎ সরকার বললে জামিন পাওয়া যাবে। আবার সরকার যখন বলে জামিন পাওয়া যাবে না, তখন জামিন পাওয়া যায় না। এখন যখন জামিন পাওয়ার একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সবাই এই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। মোট কথা আমরা একটা নৈরাজ্যের দিকে এগোচ্ছি।’
সাকা চৌধুরী: বর্তমান সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রথম দফায় গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে তাঁর ধানমন্ডির বাসা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিগ্রস্তদের তালিকায় প্রথম তালিকায় তাঁর নাম ছিল। গ্রেপ্তারের পর তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ ছয়টি মামলা হয়। এর মধ্যে তিনি পাঁচটি মামলায় জামিন পান। সর্বশেষ গত ২৮ আগস্ট একটি মামলায় জামিন পান।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে কাশিমপুর কারাগারের দুই নম্বর কারাগার ভবন থেকে বের হন সাকা চৌধুরী। এ সময় কারাগারের প্রবেশমুখে তাঁর স্ত্রী-সন্তান এবং বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী উপস্িথত ছিল। কারাগার থেকে বের হয়ে তিনি ধানমন্ডির বাসায় যান।
দুপুরে সাকা চৌধুরীর ছেলে হুমাম কাদের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জুমার নামাজ আদায় শেষে তাঁরা সপরিবারে চট্টগ্রাম যাবেন এবং সেখানে দু-তিন দিন থেকে ঢাকায় ফিরবেন।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে সম্পদের তথ্য গোপন করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একটি দুর্নীতি মামলা ছাড়াসহ কয়েকটি চাঁদাবাজির মামলার বিচারকাজ চলছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনসংক্রান্ত দুর্নীতির মামলায় এখন সাক্ষীর জেরা শেষপর্যায়ে রয়েছে। মামলাটি হাইকোর্ট স্থগিত করায় কয়েক দফা এই আদালতে বিচারকাজ স্থবিরও হয়ে পড়ে।
মুক্তি পাওয়ার পর উপস্িথত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সাকা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যাদের জন্য রাজনীতি করি, তাদের কাছে জবাবদিহি করার দায়িত্ব আমাদের রয়েছে। তাই বলতে হয়, আজকের এ পরিস্িথতির জন্য আমরা রাজনীতিবিদেরাও খানিকটা দায়ী।’
ওবায়দুল কাদের: আওয়ামী লীগের নেতা ওবায়দুল কাদের গতকাল দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে জামিনে ছাড়া পান। ওবায়দুল কাদেরের মুক্তির খবরে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কয়েক শ যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও যুব মহিলা লীগের নেতা-কর্মী জড়ো হয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যায় তারা জানতে পারে, ওবায়দুল কাদের শুক্রবার ১০টা নাগাদ মুক্তি পাবেন। এরপর গতকাল সকাল থেকে নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো হয়। হাসপাতালের নিয়ম ভেঙে কয়েক শ নেতা-কর্মী হাসপাতালের ভেতরে মিছিল করে এবং কারামুক্ত ওবায়দুল কাদেরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়।
বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ওবায়দুল কাদের মুক্তি পাওয়ার পর তাঁকে এই মেডিকেলেরই এ-ব্লকের তৃতীয় তলার ৩১৮ নম্বর কক্ষে নিয়ে ভর্তি করা হয়। তিনি বেশ কিছু দিন ধরে অসুস্থাবস্থায় এখানে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
গত বছরের ৯ মার্চ রাজধানীর খিলগাঁওয়ের একটি বাসা থেকে পুলিশ ওবায়দুল কাদেরকে গ্রেপ্তার করে। সরকারের দুর্নীতিগ্রস্তদের তালিকায় তাঁরও নাম ছিল।
তাঁর বিরুদ্ধে বিশেষ জজ আদালত-৭, আদালত-৯, আদালত-১০-এ পাঁচটি দুর্নীতির মামলার বিচার চলছে। মামলাগুলো এখন সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।
মুক্তি পেয়ে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘এবারের এই কারাজীবন অন্য সময়ের মতো নয়। এবারের কারাজীবন রাজনীতিবিদদের জন্য একটি পাঠশালা। এই পাঠশালা থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। আত্মশুদ্ধি করতে পেরেছি। এই শিক্ষা আমি দেশবাসীর সেবায় উৎসর্গ করব।’
শীর্ষ সন্ত্রাসী লিয়াকত: ধরিয়ে দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা লিয়াকত হোসেন গত বৃহস্পতিবার জামিনে মুক্তি পেয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন। সব মামলায় জামিন পাওয়ার পর আটকাদেশ দিয়ে তাঁকে কারাগারে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর আটকাদেশের মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি।
কারা প্রশাসনের উপমহাপরিদর্শক মেজর সামসুল হায়দার ছিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, বৃহস্পতিবার লিয়াকত মুক্তি পেয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে দেওয়া আটকাদেশের মেয়াদ বৃহস্পতিবার শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
পুলিশ সুত্র জানায়, ২০০৩ সালের ১ অক্টোবর পুলিশের র্যাপিড অ্যাকশন টিম−র্যাট (বিলুপ্ত) এর সদস্যরা ধানমন্ডির রাস্তা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাসহ নয়টি মামলা ও চারটি সাধারণ ডায়েরি রয়েছে। গ্রেপ্তারের পর থেকে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন।
২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম এবং তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। ওই তালিকায় লিয়াকতের নাম ছিল। পুরস্কার ঘোষণার পর পুলিশ লিয়াকতসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী আরমানের সঙ্গে লিয়াকতের সখ্য গড়ে ওঠে। সে সময় লিয়াকতের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত মুরগি মিলন ও আরমান জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকার চোরাচালান নিয়ন্ত্রণের কাজ পান। তবে বরাবরই মগবাজার এলাকার চাঁদাবাজি ছিল লিয়াকতের নিয়ন্ত্রণে।
২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর লিয়াকত গা ঢাকা দেন। একপর্যায়ে তিনি ভারতে পাড়ি জমান। সেখানে একটি হোটেলে বেশ কিছু দিন কাটানোর পর কলকাতার নিউমার্কেট এলাকায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি। ২০০২ সালের ১৯ নভেম্বর ভারতে ধরা পড়ার কিছু দিন পরে কলকাতার আদালত তাঁকে জামিনে মুক্তি দেন। এরপর তিনি ঢাকায় ফিরে এসে আত্মগোপন করেন। পরে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। লিয়াকতের প্রতিদ্বন্দ্বী সন্ত্রাসীরা র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়।