কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

bdnews24

ইসলামিস্ট মিলিট্যানসি ইন বাংলাদেশ

ইসলামিস্ট মিলিট্যানসি ইন বাংলাদেশ
মৌলবাদী সন্ত্রাসের রাজনৈতিক মানচিত্র
হাসান ফেরদৌস

ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক, একসময় ঢাকার দৈনিক সংবাদ ও পরে বিবিসি বাংলা বিভাগের সাংবাদিক, আলী রীয়াজ ২০০৪ সালে বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে তাঁর প্রথম বইটি লেখেন। গড উইলিং: দি পলিটিক্স অব ইসলামিজম ইন বাংলাদেশ নামের সে বইটি কিছুটা চটজলদি লেখা হলেও তাতে বাংলাদেশে সহিংস মৌলবাদের উত্থানের মূল বৈশিষ্ট্য ও তার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতটি নিরপেক্ষ গবেষকের দৃষ্টিতে তিনি ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, ইসলামের রাজনীতিকরণের পেছনে তাঁদের যে দায়-দায়িত্ব, দেশের মূলধারাভুক্ত রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব তা থেকে ছাড় পেতে পারেন না। দেশের প্রতিটি প্রধান রাজনৈতিক দল ও নেতা সর্বগ্রাহ্য কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে নিজেদের বৈধতা খুঁজতে ধর্মের দিকে হাত বাড়ান। এরই ফলে ক্রমেই ধর্ম ও রাষ্ট্রের ভেতর বিভাজনরেখা বিলুপ্ত হয় এবং রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানেই বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতির উত্থান ঘটে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি−দুই প্রধান দলই সে অপরাধে অপরাধী। এই দুই মধ্যপন্থী ও আপসকামী দলের পাশাপাশি কোনো প্রগতিশীল সামাজিক-গণতান্ত্রিক দল বা বামঘেষা আন্দোলন বাংলাদেশে দানা বাঁধতে পারেনি। এর ফলে যে শুন্যতার সৃষ্টি হয়, তার নরম ও উর্বর মাটিতেই মৌলবাদী শক্তি নিজেদের সংহত করার উদ্দাম ও সাহস খুঁজে পায়।

তাঁর নতুন বই, ইসলামিস্ট মিলিট্যানসি ইন বাংলাদেশ (রুটলেজ, নিউইয়র্ক, ২০০৮), তাতে রীয়াজ ইসলামবাদীদের উত্থানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের পাশাপাশি এর ভু-রাজনৈতিক মানচিত্র খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সহিংস ইসলামি রাজনীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সম্ভাবনার প্রতি কত বড় হুমকি ও সে হুমকি মোকাবিলার পথ কী, তা নির্দেশের চেষ্টাও করেছেন তিনি। এই বইয়ে আলী রীয়াজ সাংবাদিক নন, তিনি নিয়মনিষ্ঠ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। পূর্বনির্ধারিত কোনো সিদ্ধান্ত আরোপের বদলে তিনি এখানে তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে যৌক্তিক উপসংহারে পৌঁছাতে তাঁর স্পষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাঁর যুক্তি, বাংলাদেশে সহিংস ইসলামি মৌলবাদের উত্থান মূলত একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, দেশি ও বিদেশি শক্তিচক্র একযোগে তার পক্ষে কাজ করেছে। ১৯৭৫-পরবর্তী ঘটনাবলির ওপর আলোকপাত করে তিনি এই যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতর মৌলবাদ ও মৌলবাদী রাজনীতি সমর্থন ও আশ্রয় পাওয়ার ফলেই এই সহিংস মৌলবাদ এত দ্রুত প্রসার লাভ করেছে। তাঁর সবচেয়ে নির্দয় সমালোচনার লক্ষ্য ২০০১ থেকে ২০০৬-এর বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার। এই পাঁচ বছরে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র-বহির্ভুত শক্তিসমূহ (স্টেট ও নন-স্টেট অ্যাকটর্স) একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে, একে অপরকে ব্যবহার করেছে। শুধু তাদের রাজনৈতিক ও আদর্শগত উদ্দেশ্য সাধনই সেই সহযোগিতার লক্ষ্য নয়, তাদের দীর্ঘমেয়াদি রণকৌশলের অংশ হিসেবেও এই আঁতাত কাজ করেছে।
আলী রীয়াজ তাঁর গ্রন্থে প্রায় গোড়া থেকেই ইসলামিক দলগুলোর রাজনৈতিক ক্ষমতার বিষয়ে যে ‘মিথ’ চালু রয়েছে, তা ভাঙার চেষ্টা করেছেন। ১৯৯১-এর নির্বাচনের সময় থেকে জামায়াত ও অন্য ইসলামি দলগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘কিং-মেকার’-এর ভুমিকা নেয়, অথচ তাদের নীতি ও আদর্শের প্রতি দেশের জনসমর্থন বরাবরই নামমাত্র। জামায়াতে ইসলামী একমাত্র ইসলামবাদী রাজনৈতিক দল, যাদের কোনো অর্থবহ জনসমর্থন রয়েছে। কিন্তু সেই সমর্থনও গত ১৫ বছরে ক্রমাগত নিম্নমুখী হয়েছে। যেমন, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এই দল মোট ভোটের ১২ দশমিক ১৩ শতাংশ অর্জন করে। পরবর্তী প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনেই তাদের বাক্সে ভোটের পরিমাণ ক্রমেই কমে আসে। ২০০১ সালের নির্বাচনে তাদের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। অন্য কথায়, এক দশকে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন−ভোটপ্রাপ্তি ও জনসমর্থনের নিক্তিতে ৪১ শতাংশ হ্রাস পায়। তার পরেও দল হিসেবে জামায়াতের রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ে দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে উদগ্র আগ্রহ দেখিয়েছে, তা থেকে এই অব্যাহত পতনের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া অসম্ভব।
রাজনীতির যে ইসলামিকরণ, তার ফল বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়েছে নানাভাবে। সহিংসতা তার একটি প্রধান ও চুড়ান্ত প্রকাশ, কিন্তু তার অন্য প্রকাশও রয়েছে। যেমন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ক্রমাগত বৈষম্য ও সহিংসতা, নাগরিক সংস্কৃতির বিজাতিকরণ এবং মাদ্রাসা শিক্ষার উল্লম্ফন। আলী রীয়াজ তাঁর গ্রন্েথ এই শেষ বিষয়টি, অর্থাৎ মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার নিয়ে তথ্যভিত্তিক দীর্ঘ বিশ্লেষণ করেছেন। ইসলামি মৌলবাদীদের উত্থানের সঙ্গে মাদ্রাসা-ব্যবস্থার অবিশ্বাস্য প্রসার যে গুণগতভাবে সম্পৃক্ত, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ জাগে না, যখন আমরা এই তথ্যের মুখোমুখি হই যে ১৯৭২ থেকে ২০০৪ সালের ভেতর বাংলাদেশে উত্তর-প্রাথমিক মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৩২ শতাংশ। কোনো সন্দেহ নেই, আওয়ামী লীগের আমলেও মাদ্রাসা-ব্যবস্থা জোরদার হয় এবং আওয়ামী সরকার মাদ্রাসা-ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন তাদের নির্বাচনী রণকৌশলের অঙ্গীভুত করে। কিন্তু বিএনপির জোটের শেষ পাঁচ বছরে মাদ্রাসার যে প্রসার ও তার সহিংস পরিবর্তন ঘটে, পূর্ববর্তী যেকোনো সময়কে তা হার মানায়। ২০০১−২০০৫ সালে দেশের সাধারণ শিক্ষা খাতে বৃদ্ধি যেখানে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ, সেখানে মাদ্রাসা খাতের সম্প্রসারণ দাঁড়ায় ২২ দশমিক ২২ শতাংশ। একই সময়ে সাধারণ শিক্ষা খাতে মোট শিক্ষার্থীর পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ৩৩ শতাংশ, কিন্তু মাদ্রাসা ছাত্রদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৫৮ শতাংশ।
মাদ্রাসাগুলো, বিশেষ করে বেসরকারি কওমি মাদ্রাসার অনেকাংশ যে সন্ত্রাসী তৎপরতার সঙ্গে জড়িত, সে কথা পত্র-পত্রিকায় নানা সময়ে লেখা হলেও তার অকাট্য প্রমাণ মেলেনি। সে প্রমাণ মিলল ১৭ আগস্ট ২০০৫ সালে দেশজুড়ে সন্ত্রাসী বোমাবাজির পর। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক অনেক সন্ত্রাসীই পরে স্বীকার করেছে, তারা বিভিন্ন মাদ্রাসাকে প্রশিক্ষণ ও সদস্য সংগ্রহের কাজে ব্যবহার করেছে। ‘আহলে হাদিস আন্দোলন বাংলাদেশ’ ও ‘মাহাদুত তারবিয়ালতিল ইসলামিয়া মাদ্রাসা’ এই কাজে অগ্রণী ভুমিকা পালন করে। গোয়েন্দা সুত্রের তথ্য উদ্ধৃত করে আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, সরকারিভাবে এ পর্যন্ত ২৩৩টি মাদ্রাসা চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
বিএনপির আমলে ২০০১−২০০৬-এর ভেতর সহিংস ইসলামপন্থীদের তৎপরতা যে আশ্চর্য রকম বেড়ে যায়, তার প্রধান কারণ সরকারের ভেতরেই ইসলামপন্থী নীতিনির্ধারকের ভুমিকা গ্রহণ করে। এই নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশে ইসলামি সন্ত্রাসের অস্তিত্ব এক কথায় কেবল নাকচই করে দেননি, অনেক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীদের সহযোগী হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন। আলী রীয়াজ সে ধরনের বেশ কিছু প্রামাণিক উদাহরণ দিয়েছেন। হারকাতুল জিহাদ নামে যে সংগঠনটি পরে সন্ত্রাসী হিসেবে আন্তর্জাতিক কালো তালিকাভুক্ত হয়, তার অন্যতম নেতা আতাউর রহমান খান−যিনি বিন লাদেন বাহিনীর সদস্য হিসেবে আফগান-যুদ্ধে অংশ নেন−১৯৯১ সালে বিএনপির সদস্য হিসেবে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। মুফতি শহিদুল ইসলাম, যিনি ১৯৯৮ সালে বিন লাদেনের সঙ্গে বৈঠক করেন বলে নিজেই স্বীকার করেছেন, ২০০১ সালে বিএনপির সমর্থিত ইসলামী ঐক্যজোটের ব্যানারে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। কুখ্যাত বাংলা ভাইয়ের ‘জাগ্রত মুসলিম জনতা’ রাজশাহীর বাগমারায় প্রথম যে প্রকাশ্য জনসভা করে, তাতে অন্যতম বক্তা ছিলেন স্থানীয় বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ২০০৪ সালের মে মাসে রাজশাহীতে বাংলা ভাই যখন তাঁর সন্ত্রাসী অভিযানের শীর্ষে, সে সময় রাজশাহীর বিভাগীয় পুলিশের ইনস্পেক্টর জেনারেল নুর মোহাম্মদ সাংবাদিকদের জানান, সরকারি আইন প্রয়োগকারী বাহিনী বাংলা ভাইকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সাহায্য করছে। ১৮ আগস্ট ২০০৬ সালে ঢাকায় ‘সচেতন ইসলামি জনতা’ এই ব্যানারে যে প্রকাশ্য জনসভা করে, তাতেও নিষিদ্ধ ‘হুজি’র একাধিক নেতা (যেমন, মুফতি শফিকুর রহমান, মৌলানা মোহাম্মদুল্লাহ) এবং চারদলীয় জোটের একাধিক নেতা (যেমন, শাইখুল হাদিস) অংশ নেন।
রাষ্ট্র নিজেই যখন সন্ত্রাসের লালন ও পালন করে, তখন সে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় থাকে না। বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এ ব্যাপারে বিপদঘণ্টি বাজানোর চেষ্টা করেছে, সরকারি ঢਆা-নিনাদে তা সহজেই ঢাকা পড়ে যায়। কিন্তু থলের বেড়াল বেরোয়, যখন খোদ বাংলা ভাই সে কথা ফাঁস করে দেন। ২০০৬ সালের শেষ মাথায় আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তিনি সক্ষোভে বলেন, সরকারই তাঁদের ইসলামি হুকুমাত কায়েমের জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করেছিল। এখন তারাই সে কাজের জন্য মানুষের তৈরি আইনে তাঁকে শাস্তি দিচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘এ অবস্থায় এই সরকারের কি শাস্তি পাওয়া উচিত?’
সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের ভেতরও ইসলামি জঙ্গিদের সহযোগী রয়েছে, তারাও সরাসরি বা অপ্রত্যক্ষভাবে ইসলামি জঙ্গিদের তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত, এই দাবির সপক্ষে রীয়াজ একটি আগ্রহোদ্দীপক তথ্য দিয়েছেন। গোপন নথিপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, ১৯৯৯ সালে এক প্রতিবেদনে গোয়েন্দা বিভাগ জানায় যে দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক ‘সারভেন্টস অব সাফারিং হিউম্যানিটি’ নামের একটি ইসলামি সাহায্য সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের ইসলামি জঙ্গিদের যোগসাজশ রয়েছে, তারা সন্ত্রাসী তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত, এই অভিযোগে ১৯৯৯ সালের ২৫ জানুয়ারি দুজন বিদেশিসহ পাঁচ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু ইসলামী ঐক্যজোটের এক নেতা, যিনি ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সমর্থনে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন, তাঁর হস্তক্ষেপে তিন বাংলাদেশিকেই মুক্তি দেওয়া হয়। সন্ত্রাস ও রাজনীতির এই সহাবস্থানে তিক্ত এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা সে সময়ে তাঁর সরকারি প্রতিবেদনে লেখেন: ‘আমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতির কারণে ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যোগসাজশে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তৎপরতায় নিয়োজিত লোকদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অর্থহীন হয়ে পড়ছে। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সন্ত্রাসীরা নতুন করে বলীয়ান হবে। বিদেশি শক্তিসমূহও উপলব্ধি করবে, সন্ত্রাসীদের চাপের মুখে সরকার কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই গ্রহণ করবে না।’
১/১১-এর পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্র ও ইসলামি সন্ত্রাসের এই যোগসাজশের বিষয়টি আমাদের কাছে আরও খোলামেলাভাবে ধরা পড়ে। আলী রীয়াজ অতি সম্প্রতি প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই দুইয়ের যে আন্তসম্পর্ক, তার একটি তাত্ত্বিক কাঠামো প্রস্তুত করেছেন। তার ওপর ন্যস্ত ভুমিকা পালনে রাষ্ট্রের ব্যর্থতাকে রীয়াজ ‘রাষ্ট্রের অনুপস্িথতি’ বলে চিহ্নিত করেছেন। ‘অনুপস্িথত রাষ্ট্র’ যখন দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ তুলে ধরার বদলে শুধু একটি ক্ষুদ্র দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করে, তখন এক ধরনের শুন্যতার জন্ন নেয়। এই শুন্যতার সুযোগেই বাম ও ডান উভয়পক্ষের চুড়ান্তবাদী গ্রুপসমূহ চাঙা হয় এবং কাজ করার জায়গা খুঁজে নেয়। দেশের উত্তরাঞ্চল, যা সবচেয়ে অনুন্নত ও অবহেলিত অঞ্চলের অন্তর্গত, সেখানে এই দুই ধরনের চুড়ান্তবাদীরাই তাদের তৎপরতার ক্ষেত্র নির্বাচন করে। ২০০১−২০০৬ সালে যে চারদলীয় জোট ক্ষমতা গ্রহণ করে, তারা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেই ডানপন্থী গ্রুপসমূহ অর্থাৎ ইসলামি জঙ্গিদের সঙ্গে হাত মেলায়। তাদের জন্য এর পেছনে যেমন আদর্শিক চাপ ছিল, তেমনি ছিল নির্বাচনী রণকৌশলগত বিবেচনা।
তাঁর প্রথম গ্রন্েথ রীয়াজ বাংলাদেশে ইসলামবাদের উত্থানকে প্রধানত একটি ‘বাংলাদেশি ঘটনা’ বলে প্রমাণে আগ্রহী ছিলেন। এই গ্রন্েথ তিনি সে বিশ্লেষণ কিছুটা বদলে নিয়েছেন। বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ওয়াহাবি ইসলাম রপ্তানি যেমন এক ধরনের ভুমিকা রেখেছে, তেমনি পরিবর্তিত ভু-রাজনৈতিক বাস্তবতাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উপমহাদেশের দেশসমূহের ঐতিহ্যিক বৈরিতা ও প্রভাব-বলয় নির্মাণের প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় ভারত ও পাকিস্তানের ‘স্যাটেলাইট’ হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে বাংলাদেশ। রীয়াজ ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রভাবিত করার লক্ষ্যে কীভাবে বাংলাদেশ, বিশেষ করে তার সহিংস দলসমূহকে ব্যবহার করেছে, তার তথ্যপূর্ণ বিবরণ দিয়েছেন। বিদেশি অর্থ, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে পাঠানো অর্থ, কীভাবে সন্ত্রাসীকাজে ব্যবহূত হয়েছে, সে কথাও তিনি জানিয়েছেন। তাঁর হিসাবে, ২০০৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ৩৪টির মতো ইসলামি এনজিও তৎপর ছিল, যাদের মাধ্যমে সেখানে বছরে ২০০ কোটি টাকার হাতবদল হয়। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরাও জেনে বা না জেনে অর্থ প্রদানের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কাজে মদদ দিয়েছে।
ইসলামি সন্ত্রাসীরা তাদের প্রয়োজনে ‘পপুলার কালচার’, যেমন সংগীত ও নাটককে ব্যবহার করে থাকে, মৌলবাদী উত্থানের সম্পুরক কারণ হিসেবে সম্পুর্ণ নতুন এই দিকটির প্রতি আলী রীয়াজ তাঁর এই গ্রন্েথ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও অন্যরা ধর্মের নামে সহিংসতার পক্ষে উসকানি দিয়েছেন, তা কোনো গোপন কথা নয়। টেপ ও সিডিতে তাঁর ভাষণ দেশের ভেতর যেমন, দেশের বাইরেও এন্তার মেলে। আটককৃত একাধিক সন্ত্রাসী স্বীকার করেছেন, সাঈদীর ভাষণ শুনেই তাঁরা অনুপ্রাণিত হয়েছেন (যেমন, চট্টগ্রামের জেএমবির নেতা জাবেদ ইকবাল)। ইসলামি মৌলবাদীদের আয়োজিত ওয়াজ-মাহফিলের পর সহিংসতা ঘটেছে, এমন ঘটনাও অজ্ঞাত নয়। যেমন, ব্র্যাক অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংক আক্রান্ত হয়েছে। নব্বইয়ের গোড়া থেকেই এসব ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু বাংলাদেশে আমরা কখনোই খুব গুরুত্বের সঙ্গে দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে দেখিনি। এর সঙ্গে যে জঙ্গিবাদ যুক্ত, তাও ভেবে দেখিনি।
ইসলামি সংগঠনগুলো তাদের উগ্র ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচারে কীভাবে সংগীতের ব্যবহার করে থাকে, আলী রীয়াজ তার প্রতিও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাংস্কৃতিক অঙ্গসংগঠন সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী। তাদের নেতৃত্বে ২০টি ইসলামি সাংস্কৃতিক দল নিয়ে যে জাতীয় সাংস্কৃতিক জোট গঠিত হয় ২০০৫ সালের ২৩ আগস্ট, তারা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে একটি ‘ইসলামিক কনসার্ট’-এর আয়োজন করে। কনসার্ট শব্দটি বিজাতীয়, অনৈসলামিক, তা সত্ত্বেও এর ব্যবহার থেকে স্পষ্ট তরুণ ও যুবকদের আকর্ষিত করাই এই ‘সাংস্কৃতিক’ আক্রমণের লক্ষ্য। আলী রীয়াজ রণাঙ্গন শিল্পীগোষ্ঠী নামের আরেক ইসলামি দলের কথাও জানিয়েছেন। এই দল শুধু ২০০৪ সালেই ২০টি ইসলামি গানের সিডি প্রকাশ করে। তালিবান নামে যে অ্যালবাম তারা প্রকাশ করে, তার ভুমিকা হিসেবে এই ভাষ্যটি রয়েছে (আমি রীয়াজের উদ্ধৃত ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করছি): ‘ওসামা বিন লাদেন বিশ শতকের এক মহান মুজাহিদের নাম। আমেরিকা তাঁর নামে কেঁপে ওঠে। আজ সমগ্র বিশ্বে ওসামা বিন লাদেন বীরের সম্মানে ভুষিত। আমেরিকাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে হলে আমাদের দরকার ওসামা। ওসামা, মুসলিম বিশ্বের তুমি নেতা, সারা বিশ্বের মুজাহিদিনদের কাছে তুমি সবচেয়ে প্রিয়। তুমিই আমাদের জিহাদের অগ্রনায়ক।’
আলী রীয়াজের বক্তব্য অনুসারে, বাংলাদেশে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ ঠেকাতে হলে একটা প্রধান কাজ হবে সন্ত্রাসী কারা তা চিহ্নিত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। ইসলামবাদীদের দাবি উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে ইসলামি সন্ত্রাসীর মোট সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ হাজার হবে। ‘আফগান মুজাহিদ’ শুধু এমন সন্ত্রাসীর সংখ্যাই তাঁর হিসাবমতে, দুই হাজার ৮০০। নির্ঘণ্ট হিসেবে আলী রীয়াজ বাংলাদেশের প্রধান ইসলামি জঙ্গি দল ও তাদের প্রধান নেতাদের একটি তালিকা ও বিবরণ সংযুক্ত করেছেন। সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক ও তাদের অর্থ ও অস্ত্রের উৎস খুঁজে বের করা ও উৎস নির্মুল করা তাঁর বিবেচনায়, বাংলাদেশের নিজের স্বার্থে অগ্রাধিকারের সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তিনি শিক্ষা সংস্কারের পাশাপাশি দেশের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের ওপরও জোর দিয়েছেন। তাঁর প্রস্তাব, সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে হলে বাংলাদেশের মানুষ ও সরকারকে একযোগে কাজ করতে হবে। এই কাজটা সবার, কোনো এক দলের বা গ্রুপের নয়, সে কথা তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন।

২.
আলী রীয়াজের এই গ্রন্থটি আমার বিবেচনায় বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের ওপর লেখা এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ বই। এখানে তিনি কেবল জঙ্গিবাদ নামের অসুখের লক্ষণ ও গতি-প্রকৃতি চিহ্নিত করেননি, কীভাবে সে রোগের নিরাময় সম্ভব তার প্রতিও আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। তাঁর বিবেচনায়, যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বাংলাদেশের লালন, সেখানে ধর্মের নামে সহিংসতার কোনো স্থান কোনো কালেই ছিল না। রাষ্ট্রের মদদ ছাড়া এই জঙ্গিবাদের উত্থান সেখানে অসম্ভব ছিল।
ক্ষীণদৃষ্টি রাজনীতিক তাঁদের আশু স্বার্থ উদ্ধার করতে সাধ করে এই সর্বনাশ ডেকে এনেছেন, রীয়াজের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমি একমত, কিন্তু এই অপরাধে আমি শুধু রাজনীতিককে একা দায়ী করতে রাজি নই। আমরা সবাই কমবেশি সে অপরাধে অপরাধী। ইসলামিবাদের প্রধান বহির্লক্ষণ সন্ত্রাস হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে জঙ্গিদের হাতে বোমাবাজি একমাত্র সমস্যা নয়, এমনকি তা প্রধান সমস্যাও নয়। বোমাবাজির যে সমস্যা, তা আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত। দেশের আইন ও বিচার বিভাগ চাইলে সে সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। কোনো কোনো জঙ্গির বিচার ও ফাঁসির ভেতর দিয়ে সে কথার প্রমাণও মিলেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ধর্মীয় প্রশ্নে যে অসহিষ্ণুতা ক্রমেই জন্ন নিচ্ছে ও প্রসারিত হচ্ছে, সহিংস ও জঙ্গি সংস্কৃতির সেটিই প্রধান আশ্রয়স্থল। তাদের নিজস্ব ধর্মীয় প্রেসক্রিপশনে ধরা না পড়লে যেকোনো ধরনের সাংস্কৃতিক কাজকেই অনৈসলামিক বলে ইসলামি জঙ্গিরা তার ওপর চড়াও হচ্ছে। তারা যা দাবি করছে, অল্প-স্বল্প প্রতিবাদের পর আমরাও তা মেনে নিচ্ছি। আর একবার যা মেনে নেওয়া হচ্ছে, তাই ‘নর্ম’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এর একটা প্রধান কারণ, দেশের মূলধারাভুক্ত দলসমূহ প্রায় বিনা বাক্য ব্যয়ে মৌলবাদী রাজনীতি ও সংস্কৃতির এজেন্ডা নিজেদের এজেন্ডা বলে তার আত্তীকরণ করে ফেলেছে। ফলে মৌলবাদী সংস্কৃতি দেশের প্রধান সংস্কৃতিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংখ্যালঘুদের প্রতি অব্যাহত আক্রমণ ও মেয়েদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের ভেতর এই সংস্কৃতির প্রকাশ এখনো ঘটছে হরহামেশা। মধ্যরাতে শহরের রাস্তায় মেয়েরা আক্রান্ত হলে সব দোষ মেয়েদের, এ কথা বলতে সমাজের দায়িত্বসম্পন্ন লোকেরাও দ্বিধা করেন না। আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে ‘কাফন মিছিল’ খুব পুরোনো কোনো ঘটনা নয়। পত্রিকার পাতায় নিরীহ কার্টুনকে উপলক্ষ করে সেকুলার তথ্য-মাধ্যমের ওপর আক্রমণ হচ্ছে প্রকাশ্যে, কার্যত প্রশাসনিক সমর্থনে। আমাদের দৃষ্টির গোচরে বাংলা ভাষার ওপরও আক্রমণ চলছে। ব্রাਜ਼ণ্যবাদের বিরুদ্ধে জাগরণ বলে কেউ কেউ বাংলা ভাষার ইসলামিকরণের বস্তাপচা যুক্তি এখনো তুলে ধরছেন। এর কোনোটাই তুচ্ছ বলে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।
ইসলামি জঙ্গিদের ঠেকাতে হলে তাই প্রতিরোধটা হতে হবে দুমুখো। একদিকে তা হতে হবে রাজনৈতিক, অন্য দিকে সাংস্কৃতিক। সংস্কৃতি বরাবরই বাঙালিদের রাজনৈতিক অধিকার অর্জনে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। ’৫২ থেকে ’৭১−এই দীর্ঘ সময়ের সব পর্যায়েই আমাদের সামগ্রিক আন্দোলনে অবিভাজ্য উপাদান হয়ে থেকেছে সংস্কৃতি। এখন আবার প্রয়োজন সেই হাতিয়ারকে সামনে আনা, তাকে ছাতার মতো তুলে ধরা। বাঙালিদের নিজস্ব সংস্কৃতি যত প্রবল ও ব্যাপকভাবে আমাদের দৈনন্দিন সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার অবিভাজ্য উপাদানে পরিণত হবে, জঙ্গিদের প্রভাব তত হ্রাস পাবে। ক্লাসে হিজাব পরে আসার দাবি জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক, বাহবা পাওয়ার বদলে তিনি তাহলে ধিਆারের সম্মুখীন হবেন। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সেটিই হবে প্রকৃত বিজয়।
সংস্কৃতির মতো রাজনীতিতেও জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে ধীরে ধীরে। গুটি গুটি পায়ে ঢুকে এখন তারা কার্যত রাজনীতির একটি প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। প্রথমে বিরোধী রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় এবং পরে সরকারের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় জঙ্গিরা রাজনৈতিক ‘লেজিটিমেসি’ও অর্জন করেছে। তাদের এখন আর অবৈধ বা বে-আইনি বলে বাতিল করা যাবে না। এসব দলের বিরুদ্ধে একাত্তরের কথা বলে যত গালই দিই না কেন, আজকের বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিকভাবে মার্জিনাল ভাবাও মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। নির্বাচনের ভেতর দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তারা। ঠিক সে কারণে এসব দলকে ‘মডারেট ইসলামিক পার্টি’ বলে স্বীকৃতিও দিয়েছে আমাদের কোনো কোনো বিদেশি অভিভাবক। এখন তাদের ঠেকানোর একমাত্র উপায় হলো, এসব দলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করে তাদের সেই লেজিটিমেসিটুকু ছিনিয়ে আনা। আমি জামায়াত বা ইসলামি দলগুলো নিষিদ্ধ হোক সে দাবি তুলছি না, কিন্তু মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো মৌলবাদ প্রতিহত করার লক্ষ্যে যদি ন্যুনতম একটি কর্মসুচিতে একমত হয়, তাহলে জামায়াত-জাতীয় দলগুলোকে একঘরে করা কঠিন নয়।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যাঁরা ভাবেন, এমন সবাইকে সে দাবিটি তুলতে হবে, জোরে, আরও জোরে।
ইসলামিস্ট মিলিট্যানসি ইন বাংলাদেশ−আলী রীয়াজ, রুটলেজ, নিউইয়র্ক ২০০৮
নিউইয়র্ক, ২ জুলাই ২০০৮

প্রথম আলো, ২২ আগস্ট, ২০০৮

BBC Asia-Pacific

CNN.com - Asia