হাসপাতালের সামনে দলীয় কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত বুলু, মিলন
বিশেষ প্রতিনিধি
বিশেষ প্রতিনিধি
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান অবশেষে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তবে আপাতত তিনি হাসপাতালেই থাকছেন বলে জানানো হয়েছে।
গতকাল বুধবার বিকেল সাড়ে চারটায় কারা উপমহাপরিদর্শক মেজর সামসুল হায়দার ছিদ্দিকী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি ব্লকে গিয়ে তারেক রহমানের কেবিন থেকে কারারক্ষী প্রত্যাহার করে নেন এবং তাঁর মুক্তি নিশ্চিত করেন।
তারেক রহমানের মুক্তির জন্য হাসপাতালের সামনে অপেক্ষায় থাকা বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও মহিলা দলের বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের হাতে কয়েক দফায় লাঞ্ছিত হয়েছেন সাবেক বাণিজ্য উপদেষ্টা বরকত উল্লা বুলু, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলন ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক সাংসদ বিলকিস ইসলাম। সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফর রহমান খান আজাদকেও ধাওয়া করে দলের কর্মীরা। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরেই এসব ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের মারধর, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও স্েলাগানের ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে দফায় দফায় আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হলেও পুলিশকে নিষ্কিত্র্নয় দেখা গেছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের আত্মীয়স্বজন এ সময় বিড়ম্বনায় পড়ে।
বিকেল পৌনে পাঁচটায় কারা উপমহাপরিদর্শক মেজর সামসুল হায়দার ছিদ্দিকী সাংবাদিকদের জানান, তারেক রহমানকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি চিকিৎসার জন্য আপাতত হাসপাতালেই থাকবেন। কারারক্ষী প্রত্যাহারের পর তারেক রহমানের নিরাপত্তার জন্য পুলিশি পাহারার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
তারেক রহমানের আইনজীবী ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীম সাংবাদিকদের বলেন, তিনি গুরুতর অসুস্থ। তাই বাড়িতে না গিয়ে চিকিৎসার জন্য আপাতত হাসপাতালেই থাকবেন। এর পর উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, মুক্তির খবর নিশ্চিত হওয়ার পর তারেক রহমান স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি হাসপাতালের কেবিন কক্ষের জানালা দিয়ে নিচে থাকা কর্মীদের উদ্দেশে হাত নাড়েন ও কবুতর উড়িয়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানান।
প্রায় দেড় বছর কারাবন্দী তারেক রহমানের মুক্তির খবর জানানো হলে হাসপাতাল চত্বরে অবস্থানরত নেতা-কর্মীরা উল্লাসে ফেটে পড়ে। এ সময় মুহুর্মুহু স্েলাগান দেয় তারা−‘জেলের তালা ভাঙব, খালেদা জিয়াকে আনব’। সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেতা-কর্মীদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়।
বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, স্থায়ী কমিটির সদস্য চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বিকেলেই ফুলের তোড়া নিয়ে তারেকের সঙ্গে দেখা করেন।
ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল সড়কের বাসভবন থেকে গত বছরের ৮ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই দিনই গুলশান থানায় তাঁর বিরুদ্ধে কোটি টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগে মামলা করেন ব্যবসায়ী ও বিএনপির নেতা আমিন আহমেদ ভুঁইয়া। তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, কর ফাঁকি, অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ ১৩টি মামলা বিচারাধীন। সব মামলায় তিনি জামিন পেয়েছেন।
গত ৩১ জানুয়ারি অসুস্থতার কারণে তারেক রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁর মেরুদন্ডে ব্যথা রয়েছে। বিভিন্ন সময় তাঁর চিকিৎসকেরা তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন।
তারেকের বিবৃতি: গত রাতে এক বিবৃতিতে তারেক রহমান তাঁর জামিনে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানান। তিনি তাঁর মা খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং সব রাজবন্দীর মুক্তি কামনা করেন। এ ছাড়া দেশের আপামর জনসাধারণ এবং অন্য যাঁরা আল্লাহর দরবারে তাঁদের পরিবারের জন্য দোয়া করছেন, তাঁদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। তারেক রহমান তাঁর চিকিৎসক, আইনজীবী, কৃষক, কলকারখানার শ্রমিক, প্রকৌশলী, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক, প্রতিরক্ষা বাহিনী ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং অন্য সব পেশার মানুষের অকৃপণ ভালোবাসার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান।
বুলু, মিলন, বিলকিস লাঞ্ছিত: তারেক রহমানের মুক্তির খবরে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো হওয়া নেতা-কর্মীদের মধ্যে গতকাল কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। এতে এহছানুল হক মিলন, বরকত উল্লা বুলু, বিলকিস ইসলাম ছাড়াও বাড্ডার ওয়ার্ড কমিশনার পেয়ারা মোস্তফা এবং মিরপুর থানা বিএনপির নেত্রী মনিরা মোশাররফ লাঞ্ছিত হন। পরে দলের নেতা ও পুলিশের সহায়তায় এসব নেতা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন।
আগত নেতা-কর্মীরা সারাক্ষণ মিছিল, স্েলাগানে মুখর করে রাখে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। এর সঙ্গে সংস্কারপন্থী বলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনায় ভেতরে চিকিৎসাধীন অনেক রোগী, তাদের স্বজনেরা, আগত অসুস্থ রোগী, ভর্তি-ইচ্ছুক রোগী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকেরা ছাড়া অন্যরাও রীতিমতো বিপাকে পড়ে। অনেকে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করে।
বেলা পৌনে দুইটার দিকে তারেককে দেখতে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে যান সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলন। তিনি শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট এবং বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের মাঝের সড়ক দিয়ে মেডিকেলের মসজিদের প্রবেশমুখ দিয়ে ঢোকেন। এ সময় বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীও তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক সাদেউল কবির নীরব বলেন, এহছানুল হক মিলন ডি ব্লকের দিকে খানিকটা এগিয়ে যেতেই ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক ও কচুয়ার অধিবাসী বিল্লাল হোসেনের নেতৃত্বে একদল যুবক ‘ধর ধর’ বলে মিলনের দিকে এগিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই এদের অনুসরণ করে উপস্িথত শতাধিক ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মী। মুহুর্তে মিলন এদের রোষানলে পড়ে লাঞ্ছনার শিকার হন। বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা তাঁকে লক্ষ্য করে একের পর এক জুতা ও ইটপাটকেল ছুড়ে মারে।
একপর্যায়ে যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও পুলিশের সদস্যরা এগিয়ে এসে মিলনকে বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের রোষানল থেকে রক্ষা করে হাসপাতাল চত্বর থেকে বের করে নিয়ে যায়। ছাত্রদলের নেতা সাদেউল বলেন, মিলন ও ছাত্রদলের বেল্লাল হোসেনের বাড়ি চাঁদপুরের একই এলাকায়। সেখানকার অন্তর্কোন্দলের শিকার হয়েছেন মিলন। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে উপস্িথত সাংবাদিকদের সাদেউল বলেন, বিএনপির বদনাম করতে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
বরকত উল্লা বুলু: বিকেল চারটার দিকে অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী নিয়ে যুবদলের সভাপতি বরকত উল্লা বুলু বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে আসেন। প্রবেশমুখ থেকেই বুলুর অনুগামী নেতা-কর্মীদের মুহুর্মুহু স্েলাগানে ভরে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। একপর্যায়ে অবস্থানরত নেতা-কর্মীদের অনেকেও এই মিছিলে যোগ দেয়। কিন্তু মিছিলটি ডি ব্লকের ভবন ঘুরে আবার ফিরে আসতেই প্রতিরোধের মুখে পড়ে।
একদল নেতা-কর্মী তাঁকে দালাল বলে নানা কটুক্তি করতে থাকে। এ সময় বুলুর সমর্থকেরাও পাল্টাপাল্টি ধাওয়া করে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে কিছুক্ষণ পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। একপর্যায়ে ব্যাপক রোষের মুখে পড়েন বুলু। তিনি প্রথমে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের গাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন।