তারেকের মাথা ফাটার খবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকাকলেজের সামনে গাড়ি ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ
নিজস্ব প্রতিবেদক
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানের মাথা ফেটে গেছে−এমন খবর ছড়িয়ে পড়ায় গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা রাস্তায় নেমে দুটি গাড়িতে আগুন দেয় এবং অন্তত ২০টি গাড়ি ভাঙচুর করে। তাদের আগুন ধরিয়ে দেওয়ার কারণে একটি মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডারে বিস্কোরণ ঘটলে জাহাঙ্গীর আলম নামের একজন ব্যবসায়ী নিহত হন। এসব ঘটনায় আহত হয়েছে অন্তত ৫০ জন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষের কারণে পুলিশ সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় থেকে নীলক্ষেত মোড় এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। ফলে রাজধানীর অন্যান্য সড়কে যানবাহনের চাপ বেড়ে যায় এবং নগরের ব্যাপক এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
একই খবরে জাহাঙ্গীরনগর ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা।
ঢাকা কলেজ: প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বেলা দুইটার দিকে ঢাকা কলেজের ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা কলেজের সামনে মিরপুর রোডে নেমে দলীয় শ্লোগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে তারা লাঠিসোটা নিয়ে অতর্কিতে গাড়ি ভাঙচুর করতে থাকে। এরই মধ্যে কয়েকজন যুবক একটি মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো-চ-৫১-৭০২৩) আটকে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দিলে প্রচন্ড শব্দে এর গ্যাস সিলিন্ডারটির বিস্কোরণ ঘটে। সিলিন্ডারের বড় একটি অংশ পথচারী গার্মেন্টস ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমের বুকের বাঁ পাশে বিদ্ধ হয়। গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
পুড়িয়ে দেওয়া মাইক্রোবাসের চালক নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গাড়িটির মালিক জসিম উদ্দিন। তিনি বাপ্পী টুরস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। গাড়িটি ঢাকা কলেজের কাছাকাছি পৌঁছালে ৮-১০ জন যুবক লাঠিসোটা নিয়ে এসে ভাঙচুর শুরু করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এদের লাঠির আঘাতে চালক নুরুল ইসলামও আহত হন।
খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে মিরপুর রোডে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ঢাকা কলেজের সামনে সংঘর্ষ শুরু হলে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় থেকে গাউছিয়া মার্কেটের সামনের ফুটপাতের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটসহ আশপাশের সব বিপণিবিতানের সামনের ফটক ব্যবসায়ীরা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেন। ফলে কেনাকাটা করতে যাওয়া সাধারণ মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিরাপদ স্থানের খোঁজে যেতে দেখা যায়।
বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এ আচরণের নিন্দা জানিয়ে ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা বলেন, "তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে গাড়ি ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া এবং মানুষ হত্যার ঘটনা ন্যাক্কারজনক। আমরা এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাই।" ব্যবসায়ীরা এ ঘটনার প্রতিবাদে এবং জড়িতদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন।
জাহাঙ্গীর আলম নিহত হওয়ার ঘটনায় নিউমার্কেট থানায় একটি নিয়মিত মামলা হয়েছে। এজাহারে আসামি হিসেবে কারও নাম উল্লেখ করা না হলেও ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের ৩০-৪০ জনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা: জানা গেছে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানের মুক্তির দাবিতে পূর্বঘোষিত কর্মসুচির অংশ হিসেবে ছাত্রদল গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মিছিল করছিল। দুপুর পৌনে একটায় সংগঠনের সভাপতি আজিজুল বারী হেলাল ও সহসভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুর নেতৃত্বে মিছিল শেষ করে তিন শতাধিক নেতা-কর্মী কলাভবনের সামনে বটতলায় জমায়েত হয়। এ সময় মোবাইল ফোনে তারেকের আহত হওয়ার খবর পেয়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠে তারা। তারা সমাবেশ শেষ না করেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের দিকে এগোতে থাকলে চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। তারা সেখানে অবস্থান নিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। জবাবে পুলিশও লাঠিপেটা শুরু করে। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা সেখানে র্যাব ও পুলিশের দুটি গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও বেশ কয়েকটি রিকশা ভাঙচুর করে। পরে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে নেতা-কর্মীরা চারুকলা থেকে টিএসসির দিকে রওনা হয়। সেখানে তারা আরেকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। পরে তারা টিএসসি ঘুরে রোকেয়া হলের সামনে এসে একটি কালো ট্যাক্সিক্যাব ভাঙচুরের পর আগুন ধরিয়ে দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ এগিয়ে এলে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। এ ঘটনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো প্রবেশপথে পুলিশ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
জাতীয় জাদুঘরের সামনে বিক্ষোভকারীদের ইটের আঘাতে আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী অন্তরা চৌধুরী (২৪) ও তাঁকে বহন করা গাড়ির চালক আবুল খায়ের (৬০)। বিক্ষোভকারীরা গাড়িটি ব্যাপক ভাঙচুর করে। একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গাড়ির কাচ ভেঙে আহত হন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ড. সরওয়ার বারী। তাঁর কপাল কেটে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সামনে ট্যাক্সিক্যাব পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় গাড়িটির চালক শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, এ ঘটনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের দুই থেকে আড়াই শ নেতা-কর্মী জড়িত।
দোকান মালিক সমিতি: বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির চেয়ারম্যান আমির হোসেন খান গতকাল এক বিবৃতিতে ঢাকা কলেজের সামনে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করেছেন। তিনি ২৮ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমের খুনিদের গ্রেপ্তার এবং নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায় তাঁরা সারা দেশে জরুরি অবস্থার মধ্যে এই হত্যার বিচারের জন্য আন্দোলনের ডাক দেবেন বলে হুঁশিয়ার করে দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের গুজব: গতকাল ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা গাড়ি ভাঙচুর করলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এমন গুজব অবশ্য কয়েক দিন ধরেই ছিল।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আ কা ফিরোজ আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার কোনো পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষের নেই। গতকালের ভাঙচুরের ঘটনা সম্পর্কে প্রক্টর বলেন, এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কর্তৃপক্ষ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির সব নেতা-কর্মীর মুক্তি এবং বাথরুমে পড়ে তারেক রহমানের আঘাত পাওয়ার ঘটনায় গতকাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে প্রধান উপদেষ্টার কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। এ সময় মহাসড়কে গাড়ি চলাচল কিছুক্ষণ বন্ধ থাকে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, একইভাবে ছাত্রদলের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে।
বগুড়া থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, বিএনপির নেতা-কর্মীরা গতকাল রাত সোয়া আটটায় বগুড়ার গাবতলীতে ট্রেনের ইঞ্জিনে অগ্নিসংযোগ করে এবং স্টেশন মাস্টারের কক্ষ ভাঙচুর করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, তারেক রহমান আহত হওয়ার খবরে স্থানীয় বিএনপি সন্ধ্যা সাতটায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি গাবতলী রেলস্টেশনে গিয়ে বোনারপাড়া থেকে সান্তাহারগামী পদ্মরাগ এক্সপ্রেস ট্রেনটি অবরোধ করে রাখে। রাত সোয়া আটটার দিকে অবরোধকারীরা ট্রেনের চালক নাছিরউদ্দিকে মারধর করে এবং ট্রেনের ইঞ্জিনে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় ট্রেনে আটকে পড়া যাত্রীরা প্রাণভয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। গাবতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বজলুর রশিদ ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনার কথা স্বীকার করেন। তবে কারা হামলা চালিয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তারেক রহমান আহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ায় বগুড়া সরকারি আযিযুল হক কলেজে ছাত্রদল বিক্ষোভ মিছিল, অগ্নিসংযোগ ও কলেজের সামনের সড়কে গাড়ি ভাঙচুর ও অবরোধ করে।
বগুড়া (শিবগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের হাতীবান্ধা এলাকায় গতকাল বিকেলে শিবগঞ্জ উপজেলা বিএনপির ছাত্রদল ও যুবদল নেতা-কর্মীরা সড়ক ও জনপথের একটি গাড়িসহ ছয়-সাতটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় সড়ক ও জনপথের গাড়িচালক সোহরাব আলী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
প্রথম আলো: ২৬ আগস্ট, ২০০৮
এক ব্যবসায়ীর মন্তব্যকে কোট করে বলি:-
বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এ আচরণের নিন্দা জানিয়ে ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা বলেন, "তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে গাড়ি ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া এবং মানুষ হত্যার ঘটনা ন্যাক্কারজনক। আমরা এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাই।"
ছাত্রদলের এই ঘৃণ্য আচরণের বিচার অবশ্যই অবশ্যই করতে হবে। এক সন্ত্রাসীর জন্য তারা সন্ত্রাস করবে, মানুষের জানমালের ক্ষতি করবে। সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেবে, একটা সভ্য দেশে এটা কোনক্রমেই কাম্য হতে পারে না। তাদেরকে আইনের মুখোমুখি করতে হবে। না হলে বর্তমান সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। জনগণের কাছে তারা ছোট হয়ে যাবেন।