হ্যাঁ এই সেই ব্যক্তি। চিনতে পারছেন কি?
প্রথম আলো পত্রিকা (২২ জুন, ০৮) থেকে জানুন তার আরেকটি কীর্তির খবর।
সরকারি বাড়ি দখলে মুন্সি আতিকের মুনশিয়ানা
কামরুল হাসান
সরকারি বাড়ি অবৈধভাবে দখল করার অভিযোগে তিনি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন। তাঁর বার্ষিক বেতনবৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) তিন বছর স্থগিত ছিল। চাকরি শেষে তাঁর অবসরকালীন ভাতাসহ যাবতীয় পাওনাও আটকে দেওয়া হয়েছে। তবু তিনি বাড়ি ছাড়েননি। তিনি ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে করা গ্রেনেড হামলা মামলার আলোচিত তদন্তকারী ও সাবেক সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মুন্সি আতিকুর রহমান।
আলোচিত বাড়িটি রাজধানীর মিরপুর দুই নম্বর সেকশনের এফ ব্লকের তিন নম্বর সড়কে অবস্থিত বাড়ির নম্বর ৪। বাড়িটি একসময় মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সরকারি বাসভবন ছিল। ১৯৭২ সালে গণপূর্ত ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রণালয় দেড়তলা বাড়িটি পুলিশ বিভাগকে বরাদ্দ দেয়। ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে এটি মিরপুর থানার ওসির সরকারি বাসা হিসেবে ব্যবহূত হতে থাকে। মুন্সি আতিকুর রহমান ১৯৮৫ সালে মিরপুর থানায় ওসি হিসেবে যোগদান করার পর এ বাড়িতে ওঠেন। দুই বছর পর তিনি এএসপি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সে যোগদান করেন। কিন্তু বাড়িটি আর ছাড়েননি। গত ২১ বছর তিনি বাড়িটি নিজের দখলে রেখেছেন। এখন তিনি নিজেকে ক্রয়সুত্রে ওই বাড়ির মালিক বলে দাবি করছেন। সে বাড়ি ভেঙে তিনি পৌনে চার কাঠা জমির ওপর ছয়তলা ভবন বানিয়েছেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, দোতলায় থাকে মুন্সি আতিকের পরিবার; অন্য সব তলা ভাড়া দেওয়া।
তবে পুলিশের মহাপরিদর্শক−আইজি নুর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি বাড়ি দখলে রাখার অভিযোগে মুন্সি আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে মিরপুর থানায় মামলা হয়েছে। থানার পুলিশ মামলাটি তদন্ত করছে।
মিরপুর থানার পুলিশ জানায়, থানার উপপরিদর্শক (এসআই) গোলাম রব্বানী মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা। মামলায় মুন্সি আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধ দখল, প্রতারণা ও আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে। মুন্সি আতিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছিল এই মামলায়।
দায়িত্বশীল একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কোন কৌশলে সরকারি সম্পত্তি দখল করে নেওয়া যায়, এ ঘটনা তার বড় দৃষ্টান্ত। এ পুলিশ কর্মকর্তা শুধু বাড়িটি দখলই করেননি, তিনি অন্য একজনকে বাড়ির মালিক সাজিয়ে তাঁর কাছ থেকে বাড়িটি কিনে নেওয়ার কাগজপত্রও বানিয়েছেন।
মুন্সি আতিক বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলা সিআইডিতে স্থানান্তরের পর দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগে তিনিসহ সিআইডির সাবেক তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে পুলিশ। মুন্সি আতিক আনসার বিদ্রোহ মামলারও তদন্তকারী ছিলেন। ওই মামলা থেকে খালাস পাওয়া আনসার কর্মকর্তা খাদেমুল ইসলামের আবেদনের ভিত্তিতে সিআইডি ওই মামলার তদন্তও খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যশোরে উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলা, গোপালগঞ্জে কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর সভামঞ্চ ও হেলিপ্যাডের কাছে বোমা পুঁতে রাখা এবং একই জেলার বানিয়চং খিষ্টান গির্জায় বোমা হামলা এবং বিএনপি সরকারের সময়ে সিলেটে শাহজালালের মাজারে বোমা, ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলা ও বগুড়ায় এক লাখ গুলির চালান উদ্ধারের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন মুন্সি আতিক।
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মুন্সি আতিকুর রহমান অবশ্য বাড়ি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেন, তাঁর বিরুদ্ধে যে বাড়ি দখলের অভিযোগ করা হচ্ছে, সেটি পুলিশ বিভাগের ছিল না। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বাড়িটি নিজেদের দখলে নিয়ে আতাউর রহমান নামের এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে। পরে তিনি আতাউর রহমানের কাছ থেকে বাড়িটি কিনে নেন। মুন্সি আতিক বলেন, প্রকৃত মালিকের কাছ থেকে বাড়িটি কেনার পরও তাঁর বিরুদ্ধে অযথা মামলা করা হয়েছে। এ মামলায় তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, রুবেল হত্যা মামলার তদন্তকারী ছিলেন তিনি। ওই মামলায় অভিযুক্ত এসি আকরামের ঘনিষ্ঠ এক পুলিশ কর্মকর্তা এ বাড়ির ঘটনায় ইন্ধন জোগাচ্ছেন। তিনি আরও অভিযোগ করেন, মিরপুরে পুলিশের নামে বরাদ্দ দেওয়া সাতটি বাড়ি অবৈধ দখলে চলে গেছে। ওই সব বাড়ির ব্যাপারে সবাই নীরব; কেবল তাঁর বাড়িটি নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর সরব হয়ে উঠেছে।
নথিপত্রে দেখা যায়, বাড়িটি খালি করার জন্য ১৯৮৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মহানগর পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় থেকে মুন্সি আতিককে চিঠি দেওয়া হয়। আতিক বাড়িটিতে আরও এক বছর থাকার জন্য আবেদন করেন। পুলিশ বিভাগ সে আবেদন গ্রহণ করে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই এক বছরে ঘটে যায় অনেক কিছু। মুন্সি আতিকের সহায়তায় জনৈক আতাউর রহমান বাড়িটির মালিকানা দাবি করে পুলিশের বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলা করেন। পুলিশ প্রশাসন এরপর মুন্সি আতিককে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য আবার চিঠি দেয়। এর পরই সেই আতাউর রহমান বাড়িটির দখল নিতে আদালত থেকে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা নেন। কিন্তু দখলে থেকে যান মুন্সি আতিক।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, মুন্সি আতিক নিজে ওই বাড়িতে অবস্থান করে বাড়ি দখলের জন্য আতাউর রহমানকে দিয়ে মামলা করিয়ে পুলিশকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেন। এ অভিযোগ পাওয়ার পর প্রথমে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিন বছরের জন্য তাঁর বার্ষিক বেতনবৃদ্ধি স্থগিত করা হয়।
মুন্সি আতিক এরপর বাড়িটি বুঝে নেওয়ার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরকে চিঠি দেন। এ জন্য দিনক্ষণও ঠিক করা হয়; কিন্তু ওই দিন তিনি উপস্িথত ছিলেন না। পরে আতাউর রহমানের ওই মামলায় ঢাকার দ্বিতীয় সাবজজ বাড়িটি পুলিশ বিভাগের বলে রায় দেন। এরপর আতাউর রহমান জজ আদালত থেকে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা নেন। মুন্সি আতিক ওই সময় সিআইডিতে কর্মরত ছিলেন এবং ওই বাড়িতেই থাকতেন।
সর্বশেষ পুলিশ সদর দপ্তর তাঁর চাকরি শেষ হলে অবসর ভাতা স্থগিত রাখা ও যাবতীয় আর্থিক পাওনা ছাড় করার ব্যাপারে অনাপত্তি দেওয়ার জন্য সিআইডির প্রধানকে চিঠি দেয়। মুন্সি আতিক ওই চিঠির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করেন। মামলাটি এখনো চলছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশের বেদখল হওয়া বাড়ির ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে মুন্সি আতিকের বাড়িটি নজরে আসে। মুন্সি আতিকের বিরুদ্ধে সরকারি বাড়ি দখলের অভিযোগ এনে গত বছরের ১ নভেম্বর মিরপুর থানায় মামলা করা হয়।