জরুরি ক্ষমতা বিধিমালা আবার সংশোধন হচ্ছে
নীতিনির্ধারক মহলে ভাবনা
* দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি আপিলের পর জামিন ও নির্বাচন করার সুযোগ পেতে পারেন
* মামলা চলাকালে জব্দ করা সম্পদ ফেরত দেওয়া হবে
শ্যামল সরকার
দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জব্দ করা অর্থ-সম্পদ বিচার শেষ না হলেও ফেরত দেওয়া যাবে। আপিল নিষ্কপত্তি না হলেও নিম্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত যে কেউ নির্বাচন করার সুযোগ পেতে পারেন। জামিনের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরও শিথিল করা হবে। এ জন্য জরুরি ক্ষমতা বিধিমালা-২০০৭ আবারও সংশোধনের কথা ভাবছে সরকার। তবে জামিনের সুযোগ দেওয়ার সপক্ষে মত থাকলেও নির্বাচন করার সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নে দ্বিমত রয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে।
আগামী নির্বাচনের আগেই জরুরি অবস্থা পুরোপুরি প্রত্যাহারের বিষয়টিও নীতিনির্ধারক মহল খতিয়ে দেখছে। অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরই জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনা করবে সরকার। সরকারের উচ্চপর্যায়ের সুত্র থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার চার উপদেষ্টা ও দুর্নীতি দমন কমিশন−দুদকের দুই কমিশনার রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। আইন উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফের দপ্তরে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন, শিক্ষা উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান, যোগাযোগ উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) গোলাম কাদের, দুদক কমিশনার হাবিবুর রহমান, মঞ্জুর মান্নান, আইনসচিব কাজী হাবিবুল আওয়াল উপস্িথত ছিলেন।
প্রায় আড়াই ঘণ্টার বৈঠক শেষে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, সংলাপ, জাতীয় নির্বাচনের আগে পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ তৈরি, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, জরুরি ক্ষমতা বিধিমালা সংশোধন করার বিষয়ে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আইন উপদেষ্টার নেতৃত্বে কমিটি করা হয়েছে।
ড. হোসেন জিল্লুর জানান, রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিভাগীয় পর্যায়ে বড় পরিসরে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গেও সরকারের সংলাপ হবে। শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের সঙ্গেও সংলাপ হবে। আগামী ২১ জুন থেকে ঢাকার বাইরে প্রথম খুলনায় এ সংলাপ শুরু হবে।
শিক্ষা উপদেষ্টা পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ তৈরির কথা উল্লেখ করে বলেন, গত বুধবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক দফা সংলাপ হয়েছে। এ ধরনের সংলাপ চলতে থাকবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম এ মতিন বেগম জিয়া ও তাঁর দুই ছেলের মুক্তি প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে বলেন, সবকিছু আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হবে। তবে বিদেশে যেতে চাইলে তাঁকে আবেদন করতে হবে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, জরুরি ক্ষমতা বিধিমালা সংশোধন নিয়ে বৈঠকে কথা হয়েছে। বিধিমালার ১৫ ধারার সংশোধন করা হচ্ছে। তবে কোন অংশের, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু না জানিয়ে তিনি বলেন, এ সংশোধনের ফলে দুদকের দায়ের করা মামলা পরিচালনায় কোনো অন্তরায় সৃষ্টি হবে না।
সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, বৈঠকে জরুরি ক্ষমতা বিধিমালার ১৫ (৩) উপবিধি (২) সংশোধন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১৫ ধারা অনুযায়ী দুর্নীতি সম্পর্কিত অপরাধের আইনগত কার্যধারা বা মামলা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর আগে অর্থ, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ইত্যাদি অবরুদ্ধকরণ বা ক্রোকাদেশ দেওয়ার বিধান রয়েছে। ১৫(৩) উপবিধি (২) অনুযায়ী এ রকম ক্রোক করা সম্পদ মামলা নিষ্কপত্তি না হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকবে। এখন তা সংশোধন করে যেকোনো আইনি প্রক্রিয়ায় মামলা নিষ্কপত্তি না হলেও আদালত ক্রোক করা সম্পদ ফেরত দেওয়ার জন্য আদেশ দিতে পারবেন বলে বিধান রাখা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার জব্দ করা দুটি গাড়িসহ অন্যান্য সম্পদ গত বুধবার ফেরত দেওয়া হয়েছে। এখন তা আইনসিদ্ধ করতে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের জটিলতা এড়াতে এই সংশোধন করা হচ্ছে।
সুত্র জানায়, সরকার জরুরি ক্ষমতা বিধিমালার ১০, ১০(৩), (৪) ও (৫) ধারার সংশোধন নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। ৩ ধারা অনুযায়ী দন্ডাদেশপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি আপিল দায়ের করলে আপিল চলাকালীন আদালত তাঁকে জামিন দিতে এবং নিম্ন আদালতের রায় বা আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত করতে পারবেন না।
৪ ধারা অনুযায়ী আপিল নিষ্কপত্তি না হওয়া পর্যন্ত দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির নিজ নামে বা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তির নামে অর্জিত ও রক্ষিত কোনো অর্থ বা নগদায়ন কোনো বন্ড, সিকিউরিটি, শেয়ার সনদ, যেকোনো সনদ বা অনুরূপ অন্য কোনো যন্ত্রাংশ, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বিরুদ্ধে অবরুদ্ধকরণ, ক্রোক বা বাজেয়াপ্ত আদেশ বহাল থাকবে।
৫ ধারায় বলা হয়েছে, জরুরি বিধিমালায় দায়ের করা মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলেও স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে অযোগ্য হবেন।
সুত্র বলছে, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে সব দলের অংশগ্রহণকে সরকার এখন গুরুত্ব দিচ্ছে। সে জন্য সার্বিক রাজনৈতিক সমঝোতার পথ উন্নুক্ত করতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। তবে এ ধরনের সংশোধন করা হলে বর্তমানে নিম্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্তরা আপিল করে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পাবেন। ঢালাও এই সুযোগ দেওয়া হলে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ প্রশ্নের মুখে পড়ে কি না, তা নিয়েও সরকারের ভেতরে ভাবনা আছে।
একজন উপদেষ্টা বলেছেন, একবার নিম্ন আদালতে সাজা হলে আপিলের পর জামিন পাওয়ার সুযোগ রেখে জরুরি ক্ষমতা বিধিমালা সংশোধন করা যেতে পারে। তবে আপিল করেই নির্বাচন করার সুযোগ দেওয়াটা কঠিন।
ইহাকেই বলে থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়
------প্রথম আলো, ১৩ জুন