কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

bdnews24

ফারুক, রশিদ, হুদাসহ মূল আসামিরা বেকসুর খালাস!


হাইকোর্টে জেলহত্যা মামলার রায় ঘোষণা * এ রায় প্রহসন: রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি

আশরাফ-উল-আলম
১৯৭৫ সালের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, ক্ষমতা দখল-পাল্টা দখলের ধারাবাহিকতায় রাতের অন্ধকারে কারাগারে বন্দী অবস্থায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার দায় থেকে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি দফাদার মারফত আলী শাহ, দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধা ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি লে. কর্নেল (বরখাস্তকৃত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) বজলুল হুদা ও মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহাম্মদকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে পলাতক এক আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপর আট আসামির সাজাও বহাল রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মৃত্যুদন্ড নিশ্চিতকরণ (ডেথ রেফারেন্স) ও কারাগারে আটক যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের আপিলের রায় ঘোষণা করা হয়।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আতাউর রহমান খানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ এই রায় দেন। গত ১৩ জুলাই হাইকোর্টে জেলহত্যাসংক্রান্ত মৃত্যুদন্ড নিশ্চিতকরণ ও আপিল শুনানি শুরু হয়। গত ১৮ আগস্ট রায় ঘোষণা শুরু হয়। টানা আট কার্যদিবস ধরে রায় ঘোষণা করা হয়।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, এ রায় প্রহসন, দুঃখজনক ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। তিনি বলেন, রায়ে মনে হয়েছে যে একজন লোক কারাগারে এসে চারজনকে খুন করে চলে গেল। এর পেছনে যেন আর কেউ জড়িত নয়। হত্যার পেছনে কোনো পরিকল্পনা ছিল না বা কোনো ষড়যন্ত্র ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা তো ভিন্ন। আনিসুল হক বলেন, ‘এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা আপিল করব। লড়াই চালিয়ে যাব। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রতি আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমরা ন্যায়বিচার পাব।’
হাইকোর্টের রায়ে পলাতক আসামি রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ওরফে মুসলেম উদ্দিন ওরফে হিরন খান ওরফে মুসলেম উদ্দিন খানের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হয়েছে। পলাতক অপর আট আসামি কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশীদ, লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম, কর্নেল (অব.) এম বি নুর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব.) কিশমত হাশেম ও ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসারের যাবজ্জীবন কারাদন্ড বহাল রেখেছেন আদালত।
২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত জেলহত্যা মামলার রায় দেন। রায়ে পলাতক তিন আসামিকে ফাঁসি ও ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। নৃশংসতম এই হত্যার পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র খুঁজে না পাওয়ায় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. মতিউর রহমান ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত চার রাজনীতিবিদ কে এম ওবায়েদুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মেজর (অব.) খায়রুজ্জামানকে বেকসুর খালাস দেন। শুধু তা-ই নয়, ষড়যন্ত্রের কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় মামলার ২০ আসামির সবাইকে ফৌজদারি কার্যবিধি ১২০(খ) ধারায় ষড়যন্ত্রের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
জাতীয় চার নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় হত্যার ২৯ বছর পর দেওয়া নিম্ন আদালতের ওই রায়ে মূল পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে সেনা কর্মকর্তাদের যোগাযোগ ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু কারা ওই পরিকল্পনাকারী, বিচারিক আদালত তা চিহ্নিত করেননি। নিম্ন আদালতের রায় নিয়ে ব্যাপক সমালোচনাও হয়।
নিম্ন আদালত রায় দেওয়ার চার বছর পর আপিল আদালতের (হাইকোর্ট) রায়েও বলা হয়েছে, জেল হত্যাকান্ডে কোনো ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আপিল আদালতের দৃষ্টিতে জেল হত্যাকান্ড একটি বর্বরোচিত ও কাপুরুষোচিত ঘটনা মনে হলেও ঘটনার প্রকৃত নায়কদের চিহ্নিত করা যায়নি।
হাইকোর্ট বলেছেন, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আট আসামি আপিল করেননি বলে তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না। তাঁরাও আপিল করলে রায় তাঁদের অনুকুলে যেত। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের অভিমত, হাইকোর্টের দৃষ্টিতে একজনকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
হাইকোর্টের অভিমত: হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, জেলহত্যা মামলায় যাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাঁদের পরস্পরের বক্তব্যের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। একজন সাক্ষীর সঙ্গে অন্য সাক্ষীর বক্তব্যের বৈপরীত্য রাষ্ট্রপক্ষের পুরো মামলাটিকে সন্দেহপূর্ণ মনে হয়েছে। এই সন্দেহের সুবিধাটুকু আসামিরাই পেয়ে থাকেন।
আদালত বলেছেন, এই মামলার আসামিরা পরস্পর ষড়যন্ত্র করেছেন বা ঘটনা সংঘটনের জন্য বঙ্গভবন থেকে টেলিফোনে কারা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করেছেন−রাষ্ট্রপক্ষের এই অভিযোগ আদালতের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।
লে. কর্নেল (বরখাস্তকৃত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) বজলুল হুদা ও মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহাম্মদসহ বেশকিছু সেনা কর্মকর্তা জেল হত্যাকান্ডের আগে বঙ্গভবনে অবস্থান করছিলেন বলে সাক্ষীরা তাঁদের সাক্ষ্যে বলেছেন। এ প্রসঙ্গে আদালতের রায়ে বলা হয়, সেনা কর্মকর্তারা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বঙ্গভবনে আসা-যাওয়া করেছিলেন, আদালতের কাছে তা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়নি।
বঙ্গভবনের তৎকালীন কর্মকর্তারা এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের বঙ্গভবনে উপস্িথতির কথা বললেও আদালত তা বিশ্বাস করেননি। এ প্রসঙ্গে রায়ে বলা হয়েছে, ঘটনার আগে পরে কারা বঙ্গভবনে আসা-যাওয়া করেছেন, তা নির্ণয় করা হয়নি। ওই সময়কার বঙ্গভবনে রক্ষিত রেজিস্টার আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি। উপস্থাপন করা হলে অবশ্যই বঙ্গভবনে যাতায়াতকারীদের চিহ্নিত করা যেত।
কারাগার সম্পর্কেও আদালত বলেন, ঘটনার সময়কার কারা রেজিস্টারগুলো আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি বলে কারাগারে কে কে প্রবেশ করেছিলেন, তা চিহ্নিত হয়নি। এসব কারণে আদালত কারাগার ও বঙ্গভবনের সাক্ষীদের সাক্ষ্য বিশ্বাস করেননি।
কর্নেল শাফায়াত জামিলের সাক্ষ্য আদালত গুরুত্ব দিয়েছেন বলে রায়ে বলা হয়। কিন্তু ওই সাক্ষীর সাক্ষ্যকে অন্য কোনো সাক্ষী সমর্থন করেননি। যে কারণে সন্দেহের ঊর্ধ্বে গিয়ে মামলা প্রমাণ করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি মারফত আলী ও আবুল হাশেম মৃধার ঘটনাস্থলে উপস্িথতি সম্পর্কে তিনজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। এই তিনজন সাক্ষী যে ঘটনাস্থলে উপস্িথত ছিলেন, তা আদালতের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি বলে রায়ে বলা হয়েছে। আসামিদের শনাক্ত করার বিষয়ে সাক্ষীরা যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাও আদালতের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালতে উপস্িথত করা হয়নি বলে রায়ে বলা হয়েছে।
এই মামলার বিচার চলাকালে আসামিপক্ষ জেলহত্যার ঘটনা খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের ফল বলে দাবি করেছিল। এ প্রসঙ্গে রায়ে আদালত বলেছেন, খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান চেষ্টাকারীদেরও এই ঘটনায় সম্পৃক্ত করার বিষয়টি আদালত বিবেচনায় নিয়েছেন।
জেলহত্যা মামলাটি যথাযথভাবে তদন্ত হয়নি বলে আদালত বারবার তাঁর রায়ে উল্লেখ করেছেন। আদালত বলেছেন, তদন্ত কর্মকর্তা সঠিকভাবে তদন্ত করলে প্রকৃত দুষ্ককৃতকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হতো।
ঘটনার বিবরণ: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একই বছরের ৩ নভেম্বর রাত চারটার দিকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। ৪ নভেম্বর তৎকালীন কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি, প্রিজন) আব্দুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তাঁর নেতৃত্বে চার-পাঁচজন সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করেন।
অভিযোগপত্র: ঘটনার পরদিন মামলা দায়ের করা হলেও এই মামলার তদন্ত ২১ বছর থেমে ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলো জেলহত্যা মামলার তদন্তে বাধার সৃষ্টি করে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তদন্ত শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ−সিআইডির এএসপি আবদুল কাহার আকন্দ ২১ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। আসামি আবদুল আজিজ পাশা মামলা চলাকালে জিম্বাবুয়েতে মারা যাওয়ায় তাঁকে রায়ের আগে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। মোট ৭৫ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬৪ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয় এই মামলায়।
গতকালের আদালত: গতকাল রায় ঘোষণার সময় আদালতের নিরাপত্তাব্যবস্থা কিছুটা বাড়ানো হয়। তবে নিহতদের আত্মীয়রা কেউ উপস্িথত ছিলেন না। সংবাদকর্মীদের উপস্িথতি লক্ষণীয় হলেও কোনো রাজনীতিক বা সাধারণের উপস্িথতি চোখে পড়ার মতো ছিল না।
আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া: রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট আনিসুল হক রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এর আগেও বিভিন্ন মামলায় হাইকোর্ট বাজে রায় দিয়েছেন। ওই সব রায় কিছুক্ষণের জন্য হতাশা তৈরি করলেও আপিল বিভাগে সে হতাশা কেটে গেছে। তিনি বলেন, সার্বিকভাবে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির প্রতিটি লোকই এ রায়ে মর্মাহত।
জেলহত্যা মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আরেক আইনজীবী শ ম রেজাউল করিম বলেন, হাইকোর্টের রায় অপ্রত্যাশিত। যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে এই মামলায়। সাক্ষ্য ও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা সব আসামির সাজা বহাল রাখার জন্য যথেষ্ট। অ্যাডভোকেট মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, জেল হত্যাকান্ড সম্পর্কে আপিল আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক নয়।
আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, জেলহত্যার সঙ্গে এই আসামিরা জড়িত ছিলেন না তা প্রমাণিত হয়েছে। খালেদ মোশাররফের অনুসারীরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, এটাও এ রায়ে স্পষ্ট হয়েছে। তিনি জেলহত্যা মামলার বিচার চেয়ে বলেন, ‘প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।’

প্রথম আলো, ২৯ আগস্ট ২০০৮

BBC Asia-Pacific

CNN.com - Asia