কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

bdnews24

তেহরানে উদ্ভট প্রচার

অজয় দাশগুপ্ত

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ছিল নারকীয়। কিন্তু জনতার প্রতিক্রিয়া কী ছিল? অভ্যুত্থানের বিষয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস ওয়াশিংটনে ১৬ আগস্ট তার ‘প্রাথমিক মন্তব্যে’ জানিয়েছেন : ‘প্রথম ২৪ ঘণ্টার ঘটনাবলি থেকে স্পষ্ট যে অভ্যুত্থান চ্যালেঞ্জ হবে না।’ আর জনগণের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? এ প্রসঙ্গে ইউজেন বোস্টারের মন্তব্য : ‘জনগণ মুজিবের পতনে বিশেষ কোনো আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি। বরং তাদের মনোভাব ছিল : শান্তভাবে মেনে নেওয়া এবং সম্ভবত কিছুটা স্বস্তির প্রকাশ। যে তুলনামূলক সহজভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে তা থেকে এটা বলা যায়, মুজিব এবং বাঙালিরা পরস্পর থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। বাঙালিরা মুজিবের কাছ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছিল, কারণ তিনি তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ডাইন্যাস্টির মনোভাবও তার মধ্যে কাজ করেছে। অন্যদিকে মুজিব জনগণ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন, কারণ তিনি বাস্তবানুগ পরামর্শ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন এবং নিজেকে অসীম ক্ষমতাধর শাসক ভাবতে শুরু করেছিলেন।’

[যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের ভাষ্য থেকে স্পষ্ট, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যে পরিবর্তন সংঘটিত হয় তাতে জনগণের প্রতিক্রিয়ায় আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছিল না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরা বিশেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এবং তার সহকর্মীরা যে খুশি হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। অসাংবিধানিক উপায়ে রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমদের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণকে বোস্টার অভিহিত করেছিলেন ‘তুলনামূলক সহজে ক্ষমতা হস্তান্তর’ হিসেবে। তিনি মুজিবের ‘পতন’ শব্দটিও ব্যবহার করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দেশের শাসনভার যারা গ্রহণ করেছিলেন- খন্দকার মোশতাক আহমদ ও জিয়াউর রহমানসহ, তারা বিভিন্ন সময়ে দৃঢ়তার সঙ্গেই দাবি করছিলেন, ‘মুজিবের পতনে’ বাংলাদেশের জনতা আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করে। এ দাবি যথার্থ ছিল না। এটা ঠিক যে হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক গণবিক্ষোভ ঘটেনি। স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতিকে পরিবারের নারী-শিশুসহ নিষ্ঠুর উপায়ে হত্যার পর যে ধরনের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে শগ্ধিকত ছিল যুক্তরাষ্ট্র সেটাও দেখা যায়নি। কিন্তু এ থেকে হত্যাকা- মেনে নেওয়া বোঝায় না।]

অভ্যুত্থানের ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনে নিশ্চিত খবর পাঠান : ‘এ পর্যন্ত প্রাপ্ত লক্ষণ থেকে ধারণা করা যায়, নতুন সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এমনকি মুজিবের সময়ের তুলনায় অধিকতর আন্তরিক ও বন্ধত্বপূর্ণ হবে।’

[ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে ঠিক এটাই ঘটেছিল।]

১৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ইরানি দূতাবাস ওয়াশিংটনে হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে তেহরানের একটি দৈনিকে বাংলাদেশের অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে একটি বার্তা প্রেরণ করে। এর কপি ঢাকায় বোস্টারের কাছেও পাঠানো হয়। এর শিরোনাম ছিল : ‘ঢাকায় দক্ষিণপন্থি অভ্যুত্থান ঘটেছিল সোভিয়েতপন্থি অভ্যুত্থানের পর।’

প্রতিবেদনে বলা হয় : “ফারসি ভাষার পত্রিকা ‘কেইহান’ ১৭ আগ¯দ্ব তাদের প্রতিবেদনে দাবি করে, ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে দুটি অভ্যুত্থান ঘটেছিল। একটি শুরু হয় রাত সাড়ে তিনটায়- সোভিয়েতপন্থি এ অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব নিহত হন। এরপর সকাল সাড়ে পাঁচটায় দক্ষিণপন্থি পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে, যাতে বামপন্থি অভ্যুত্থানকারীদের মৃত্যু ঘটে। আমাদের ধারণা এ তথ্যের সূত্র হচ্ছে বার্তা সংস্থা এএফপি, তাদের দাবি বাংলাদেশ সরকার এ মত সমর্থন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইরানের অন্য ফারসি ও অন্যান্য ভাষার সংবাদপত্রগুলো ঘটনার এ ধরনের ভাষ্য উল্লেখ করেনি।”

‘এ ভাষ্যে বলা হয়, মুজিব যেসব মস্কোপন্থি বামপন্থিকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়েছিলেন তারাই কয়েক মাস ধরে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা আঁটছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ [সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী], আবদুস সামাদ আজাদ [বঙ্গবন্ধু তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেননি, তবে তার পরিবর্তে ড. কামাল হোসেনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে তাকে কৃষি মন্ত্রণালয় দেওয়া হয়], মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন, কামারুজ্জামান [আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করায় তার মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার সুযোগ ছিল না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দল ও সরকার পরিচালনায় ভিন্ন ব্যক্তি রাখার পক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছিলেন। পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠনের পরও তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তবে ১৯৭৫ সালের ৭ জুন বাকশাল গঠনের সময় তিনি এ অবস্থান থেকে সরে আসেন- তিনি একই সঙ্গে দেশের রাষ্ট্রপতি এবং দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন], আবদুর রব [সম্ভবত আবুদর রব সেরনিয়াবাত, তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হয়নি। ১৫ আগস্ট তাকে পরিবারের কয়েকজন সদস্যসহ হত্যা করা হয়], কোরবান আলী [তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হয়নি। তিনি দলে বামপন্থি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন না। বরং যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হিসেবে তাকে মনে করা হতো। আশির দশকে তিনি এইচএম এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন] এবং মস্কোয় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামসুল হক। মুজিবের দু’জন কাজিন শহীদ ও মনির বামপন্থিদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। [প্রকৃতপক্ষে ভাগ্নে, মনির নয়, শেখ ফজলুল হক মনিকে বোঝানো হয়েছে। তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু তাকে কেউই বামপন্থি মনে করত না। তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে তার অবস্থানও সুবিদিত। শেখ শহীদুল ইসলাম ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের সমন্বয়ে গঠিত একক ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কোনো প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলায় উদ্যোগী হননি। আশির দশকে তিনি সামরিক শাসক এইচএম এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন।] তেহরানের পত্রিকাটির দাবি : ‘সাবেক উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামও বামপন্থিদের সঙ্গে ছিলেন। বামপন্থি এ গ্রুপের শঙ্কা ছিল, মুজিব পাশ্চাতের দিকে ঝুঁকে পড়বেন। দক্ষিণপন্থিরাও আগস্টের শেষদিকে একটি অভ্যুত্থান সংগঠনের পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু তাদের লক্ষ্য ছিল শেখ মুজিবকে প্রতীকী ক্ষমতায় রেখেই এগিয়ে যাওয়া। খন্দকার মোশতাক ছাড়াও তাদের সঙ্গে আরো ছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আবদুল মান্নান [শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক], আবু সাঈদ চৌধুরী [সাবেক রাষ্ট্রপতি- ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করায় তাকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৪ সালে পদত্যাগ করেন। খন্দকার মোশতাক আহমদ তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ করেছিলেন], অধ্যাপক ইউসুফ আলী [মুজিব মন্ত্রিসভার শিক্ষামন্ত্রী]। যখন তারা ১৪ আগস্ট দিবাগত গভীর রাতে বামপন্থিদের অভ্যুত্থানের খবর পান (সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যেসব গোয়েন্দা কাজ করছিল তাদের মাধ্যমে) তারা সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা রেডিও সেন্টার দখল করে নেয় এবং অভ্যুত্থানের খবর প্রচার করে। তবে এ সময় মুজিবের হত্যাকাণ্ড বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সৈন্যরা তখন ধানমণ্ডি এবং অফিসার্স ক্লাবের আশপাশে লড়াইয়ে নিয়োজিত ছিল। এতে উভয়পক্ষে ব্যাপক সংখ্যক সৈন্য নিহত হয়। মস্কোপন্থি অভ্যুত্থানকারীরা ঢাকা আক্রমণের জন্য হাজার হাজার সশস্ত্র লোককে প্রস্তুত রেখেছিল কিন্তু দক্ষিণপন্থিরা রাজধানীকে ঘিরে ফেলে সামরিক আইন জারি করে এ পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়।’

[ইরানি সংবাদপত্রটির ভাষ্য ছিল একেবারেই আষাঢ়ে গল্প। কিন্তু ওই সময়ের দেশি-বিদেশি সংবাদপত্রে এ ধরনের অনেক খবর প্রকাশিত হয়। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের নামি-দামি অনেক সংবাদপত্রও অংশ নেয়। বিশেষভাবে এর লক্ষ্য ছিল শেখ মুজিবকে হেয় প্রতিপন্ন করা। তাকে হত্যা ব্যতীত যে কোনো উপায় ছিল না, সেটাও বলা হতে থাকে। ওই সময়ে ঘাতকরা প্রচার করেছিল, মুজিব চেয়েছিলেন তার পুত্র শেখ জামালকে সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করা। শেখ ফজলুল হক মনি হবেন প্রধানমন্ত্রী এবং শেখ কামালকে দেওয়া হবে ছাত্র সংগঠনের দায়িত্ব। অভ্যুত্থান চলাকালে হতাহত নিয়ে গুজব থাকতেই পারে। যেমন- ১৫ আগস্ট গুজব ছিল, প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী নিহত হয়েছেন। অভ্যুত্থানের পেছনে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন, এমন রটনাও প্রথমদিকে ছিল। এটা পরিকল্পিত হওয়ারই সম্ভাবনা। খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালেই পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চালান। তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের যোগসাজশ ছিল। এটা ব্যর্থ করে দেওয়ার পেছনে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সক্রিয় তৎপরতা সুবিদিত। খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতা দখল করার পর তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্ভর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং আবু হেনা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের সঙ্গে তাকেও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।]

সমকাল, ২২ আগস্ট, ২০০৮

BBC Asia-Pacific

CNN.com - Asia