কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

bdnews24

দারিদ্র্যকে নিয়ে মশকরা

রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি- এই পোস্টের এমন নামকরণ করার ইচ্ছা ছিল। খবরের হেডিং দেখেও তাই মনে হয়। কিন্তু বিস্তারিত পড়ার পর মত পাল্টাতে বাধ্য হলাম। এটা বস্তিবাসীদের মানবিক অধিকারকে শুধুমাত্র ব্যঙ্গ করা হয়েছে তা নয়, এখানে মানবতার চরমতম অপমান ঘটেছে। সচেতন মানবিক মানুষ এতে উদ্বিগ্ন বোধ না করে পারে না।

বস্তিবাসীর এক হাজার ফ্ল্যাট বিত্তশালীদের দখলে
নামেই পুনর্বাসন প্রকল্প
অমিতোষ পাল

ছিন্নমুকুল ও বস্তিবাসীদের আবাসনের জন্য নির্মিত ফ্ল্যাট তাদের কপালে জুটছে না। ভিটেহীনদের পরিবর্তে সেখানে বিত্তশালীরা জায়গা করে নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে এক হাজার ফ্ল্যাট বস্তিবাসীকে হস্তান্তর করার কথা সরকারের তরফ থেকে বলা হলেও বাস্তবে দেখা গেছে, অতীতে বস্তিতে থাকতেন, এমন কেউই ওই ফ্ল্যাট কিনতে পারেননি। বরং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বীরাই সেগুলো কিনে দখলে নিয়েছেন। চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, প্রবাসীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীই এখন ফ্ল্যাটগুলোর মালিক। সরেজমিনেও এর সত্যতা মিলেছে। অনেকেই বিলাসবহুল প্রাইভেটকারে চড়ে বুকিং দিতে আসছেন। বেশভূষা দেখেই বোঝা যায়, তারা আদতেও অর্থপীড়িত বস্তিবাসী নন।

বস্তিবাসীর জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান নর্থসাউথ প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের (এনএসপিডিএল) চেয়ারম্যান আবদুর রহিমও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ফ্ল্যাটগুলো বস্তিবাসীর জন্য নির্মিত হলেও নিন্ন আয়ের মানুষের কাছ থেকে মোটেই সাড়া পাওয়া যায়নি। ঋণ সুবিধা না থাকলে বস্তিবাসীদের পক্ষে ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব নয়।

জানা গেছে, নগরীর ফুটপাত, রেললাইন বা সরকারের খাসজমিতে গড়ে ওঠা হতদরিদ্র বস্তিবাসীর বাসস্থানের জন্য ১৯৯৮ সালে এনএসপিডিএলকে রাজধানীর মিরপুরের কচুক্ষেত সংলগ্ন ভাসানটেকে ৭৫০ একর জমি বরাদ্দ দেয় সরকার। নাম দেওয়া হয় ভাসানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প। উদ্দেশ্য নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান দরিদ্র মানুষদের স্বল্পমহৃল্যে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেবে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও বস্তিবাসীর মধ্যে এক হাজার ফ্ল্যাট হস্তান্তরের বিষয়টি বেশ জোর দিয়ে উল্লেখ করেন। কিন্তু দেখা গেছে, ফ্ল্যাটগুলোতে নাগরিক সুবিধা না থাকায় আট শতাধিক পরিবার ফ্ল্যাটে উঠতে পারেননি। যারা উঠেছেন, তাদের মধ্যে এমন কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি, যারা একদিনের জন্যও বস্তিতে থেকেছেন। বস্তিতে থাকার প্রসঙ্গ টানলে তারা বিস্মিত হন। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন, লাখ লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনার ক্ষমতা কি বস্তিবাসীর আছে? এটা নামেই বস্তিবাসী পুনর্বাসন প্রকল্প।

জানা গেছে, প্রকল্পে তিন ধরনের ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও আপাতত দু’ধরনের ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে। ‘এ’ টাইপ ফ্ল্যাটের আয়তন ২১৫ বর্গফুট ও ‘বি’ টাইপের ফ্ল্যাটের আয়তন ৩৯৫ বর্গফুট। ‘এ’ টাইপে আছে একটি শয়নকক্ষসহ ছোট বাথরুম ও রান্নাঘর। ‘বি’ টাইপে আছে আরেকটি ড্রইং রুম। ‘এ’ টাইপ ফ্ল্যাটের জন্য গ্রাহককে ১০০ টাকার নির্ধারিত ফরমে আবেদন করে জমা দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। এরপর এক সপ্তাহের মধ্যে ৫০ হাজার টাকার বুকিং মানি। পরবর্তী ১২০ দিনের মধ্যে সাকুল্যে ২ লাখ টাকা জমা দিতে হয়। এছাড়া উন্নয়ন ফি ২৫ হাজার টাকা, গ্যাস সংযোগ ফি ২৫ হাজার ও রেজিস্ট্রি ফি বাবদ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। ‘এ’ টাইপের একটি ফ্ল্যাট কিনতে সর্বসাকুল্যে ব্যয় ৩ লাখ টাকা। একইভাবে ‘বি’ টাইপের ফ্ল্যাটের জন্য প্রয়োজন প্রায় ৬ লাখ টাকার। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ছিন্নমুকুল হতদরিদ্র মানুষের পক্ষে জোগাড় করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কাজেই মধ্য আয়ের মানুষের হাতেই সেগুলো চলে যাচ্ছে।

সৌদি প্রবাসী এক ব্যক্তি ভাসানটেক পুনর্বাসন প্রকল্কেপ্পর বি-৫ ভবনের নিচতলায় বি টাইপ ফ্ল্যাট কিনেছেন। বর্তমানে তার স্ত্রী সন্তান-সন্ততি নিয়ে সেখানে বাস করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, তাদের চৌদ্দগুষ্টির কেউই কোনো দিন বস্তিতে ছিলেন না। কম দামের খবর শুনে স্বামী আগ্রহী হন। কিন্তু ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা নির্ধারিত দামের বাইরেও মসজিদ নির্মাণের জন্য ২৫ হাজার টাকা, রেজিস্ট্রি ফি ৫০ হাজার টাকা ও গ্যাসের জন্য ২৫ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে।

বি-৫ ভবনের নিচতলার ফ্ল্যাট মালিক গাজীপুর ব্র্যাক অফিসের কর্মকর্তা মোঃ ওয়ালীউল্লাহর স্ত্রী জানান, গত জানুয়ারিতে ফ্ল্যাট হস্তান্তরের কথা ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়নি। মে মাসে বুঝিয়ে দেওয়ার পর ফ্ল্যাটে উঠলেও গ্যাস না পাওয়ায় কেরোসিনের চুলায় রান্না করতে হচ্ছে। তিনি জানান, শুরুতে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলেছিল এনএসপিডিএল। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের টাকার অঙ্ক বাড়ছে।
বি-৩ ভবনের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী মোঃ মোস্তফার কন্যা বীথি জানান, বেসিন, চুলা, বাথরুমে কাপড়-চোপড় রাখার রড- এ ধরনের কোনো সামগ্রীই ফ্ল্যাটে দেওয়া হয়নি। গ্যাস না থাকায় প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা ব্যয়ে সিলিন্ডার কিনতে হচ্ছে।

বি-২ ভবনের এ টাইপ ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এপেক্স গ্রুপের কর্মকর্তা সালিমুল ইসলামের পরিবারের সদস্যরা জানান, যেসব সুবিধা দেওয়ার কথা ছিল, তারা তা পাননি। এমনকি ফ্ল্যাটের ভেতরে নিজস্ব উদ্যোগে ডিসটেম্পার করতে গেলেও কর্তৃপক্ষ বাধা দেয়। সম্প্রতি কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে একজন ফ্ল্যাট মালিক ডিসটেম্পার করায় তার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে এনএসপিডিএল।

আয়ুর্বেদিক হাসপাতালের কর্মকর্তা নূসরাত বেগমও অনুরূপ অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাইরে ৩ টাকা হলেও তাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ৬ টাকা হারে। নানা ওয়াদা বরখেলাপের পাশাপাশি তারা কেউই যে বস্তিতে ছিলেন না সেটাও অবলীলায় স্বীকার করেন। অথচ রাজধানীর ভাসানটেকে অতিগুরুত্বপূর্ণ সাড়ে সাত শ’ একর জমি সরকার এনএসপিডিএল’কে দিয়েছিল দরিদ্র মানুষের আবাসনের জন্যই। সে লক্ষ্যে ভাসানটেকের বস্তিটিও উচ্ছেদ করা হয়। বর্তমানে ১৫ হাজার ২৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ পুরোদমে চললেও তাদের ভাগ্য আর খোলেনি। কারণ নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে বিপুল অর্থ দিয়ে এই ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব নয়।

এসব বিষয় সম্পর্কে এনএসপিডিএলের চেয়ারম্যান আবদুর রহিম বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষ আবেদন করলেও তাদের অংশগ্রহণ খুবই কম। ঋণ সুবিধার ব্যবস্থা না থাকায় তাদের পক্ষে ফ্ল্যাট কেনা অসম্ভব। বিষয়টি নিয়ে সরকার ও বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে মিটিং করেছি। বিদেশি কয়েকটি উন্নয়ন সংগঠনের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। অন্যান্য অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, তিতাসে আবেদন করা হয়েছে। তারা গ্যাস সংযোগ দিলে আমরাও দিয়ে দেব। অতিরিক্ত ফি নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চুক্তি মোতাবেকই সব নেওয়া হচ্ছে।

খবর: সমকাল ২২ জুন ২০০৮

BBC Asia-Pacific

CNN.com - Asia