৩১ মে'র প্রথম আলো পত্রিকার হেডলাইন। কি অদ্ভুত ও ভয়ানক ঘটনা। টাকার জোরে মানুষ কিই না পারে? বিস্তারিত নিচে-
অরূপ দত্ত
গুলশান-বারিধারা লেকপাড়ে শাহজাদপুর এলাকায় ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির সঙ্গে লেকের জায়গা ভরাট করে ২০ তলা মরিয়ম টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছিল। অভিযোগ আছে, লেকের জায়গা ভরাট করার সময় এবং নকশার বাইরে বিশাল ভবন নির্মাণকালে লেকের অভিভাবক রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কোনো বাধা দেয়নি। মরিয়ম টাওয়ার নির্মাণের কারণে লেকের আরও অংশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, ফলে রাজউকের চলমান ‘লেক উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হচ্ছে। রাজউক সুত্র এবং এলাকায় গিয়ে এসব তথ্য জানা যায়।
রাজউকের ৩৭৫ কোটি টাকার লেক উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে গুলশান-বাড্ডা শুটিং ক্লাব থেকে মরিয়ম টাওয়ার-২ পর্যন্ত ৪০ ফুট চওড়া সড়ক বা ‘ড্রাইভ ওয়ে’ এবং লেকজুড়ে পায়ে চলার পথ বা ‘ওয়াক ওয়ে’ নির্মাণ, লেককে দুষণমুক্ত রাখা ইত্যাদি। ‘ড্রাইভ ওয়ে’ ও ‘ওয়াক ওয়ে’ করার কারণ লেকের সীমানা পুনশ্চিহ্নিত করার কাজটি সহজ করা এবং নতুন করে দখল হতে না দেওয়া। কিন্তু রাজউকের উচ্ছেদ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে মরিয়ম টাওয়ার কর্তৃপক্ষের পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় রাজউক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। যদিও রাজউকের নকশা অনুযায়ী মরিয়ম টাওয়ার নির্মাণ করা হয়নি এবং নির্ধারিত উচ্চতার চেয়ে ৩২ ফুট বাড়তি তলা করা হয়েছে বলে রাজউকের জরিপে ধরা পড়েছে। রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, নকশা অনুযায়ী জায়গা তো ছাড়া হয়ইনি, উল্টো লেকের জায়গাও নেওয়া হয়েছে।
মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কাছে গুলশান ১০৬ নম্বর সড়কে দাঁড়িয়ে লেকের দিকে উত্তর পাশে তাকালেই শাহজাদপুর এলাকায় সহজেই চোখে পড়ে লেকে শোভা পাওয়া বিশাল অট্টালিকা মরিয়ম টাওয়ার। এলাকায় বহুদিন ধরে বসবাস করছেন−এমন কেউ কেউ মন্তব্য করেন, কয়েক দিন পর ভরা বর্ষায় মরিয়ম টাওয়ারকে মনে হবে লেকেরই অভ্যন্তরে পরিকল্পিত একটি স্থাপনা। মানারাত ইউনিভার্সিটির পাশের একটি বাড়ির বাসিন্দা আবদুর রউফ বলেন, এক যুগ আগে যখন মরিয়ম টাওয়ারের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল, তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাধা দেয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় এলাকায় লেকের আরও জায়গা ভরাট হয়েছে। মরিয়ম টাওয়ারে বসবাসরত একাধিক বাসিন্দারও প্রশ্ন, এই বিশাল ভবন নির্মাণের সময় রাজউক কোথায় ছিল?
মরিয়ম টাওয়ারের অংশ যে লেকের মধ্যে পড়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় স্বাধীনতার আগে থেকে এলাকায় বসবাসরত বৃদ্ধা জেবুন্নেসা বেগমের সঙ্গে কথা বলে। তিনি এখন মরিয়ম টাওয়ারের পূর্ব দিকে একটি কলোনিতে বসবাস করেন। এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভবনটি যেখানে নির্মিত হয়েছে, স্বাধীনতাযুদ্ধের পরও তাঁর ভাষায় সেখানে ‘গাঙ’ ছিল। তিনি জানান, বছরের পর বছর চোখের সামনেই তিনি জলাশয় ভরাট করে ‘দালান’ নির্মাণ করতে দেখেছেন। কখনো কেউ বাধা দেয়নি।
মরিয়ম টাওয়ারের অংশবিশেষ ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গায় হলেও কিছু জায়গা লেকের মধ্যে পড়েছে বলে নথিপত্রের ভিত্তিতে রাজউক সুত্র দাবি করেছে। তবে এই টাওয়ারের ফ্ল্যাটের মালিকেরা দাবি করেন, ভবনের নকশায় ত্রুটি থাকলেও জমির মালিক লেকের কোনো জায়গা দখল করেননি।
রাজউকের ম্যাজিস্ট্রেট আ শ ম ইমদাদুদ দস্তগীর প্রথম আলোকে বলেন, মরিয়ম টাওয়ারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে। আর বাড়িটি যে লেকের জায়গায় ঢুকে পড়েছে, লেকের এলাইনমেন্ট অনুসারে তা বোঝা যায়। তিনি বলেন, মরিয়ম টাওয়ারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না গেলেও ইতিপূর্বে অভিযান চালিয়ে এলাকায় নির্মিত বাঁশের কাঠামো ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। লেকপাড়ের ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গাগুলো রাজউক উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে আগেই অধিগ্রহণ করেছিল। মরিয়ম টাওয়ারসহ এখানে ভরাট করা জমির মালিক দাবিদারেরা যদি প্রমাণ করতে পারেন যে এসব জায়গার প্রকৃত মালিক তাঁরা, তাহলে রাজউক জমিগুলো আবারও অধিগ্রহণ করার উদ্যোগ নিতে পারে।
রাজউক সুত্র জানায়, ইতিমধ্যে লেক ভরাটের কারণে একজনের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করা হয়েছে।
এলাকার পুরোনো বাসিন্দা ও রাজউকের দায়িত্বশীল সুত্রমতে, মরিয়ম টাওয়ারের কাছে লেকের জায়গা ভরাট করে প্লট সৃষ্টি করা হয়েছে রাজউকের অনুমোদনেই। ১৯৯৪ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে গুলশান ১৩১ নম্বর ও ৭২ নম্বর সড়কপ্রান্ত ও পার্শ্ববর্তী এলাকার লেক ভরাট করে ৩২টি প্লট তৈরি করা হয়। ক্ষমতা এবং টাকার জোরে সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও প্রভাবশালীরা এসব প্লট কিনে সেখানে বহুতল ভবনও করেছেন।
মরিয়ম টাওয়ারের ইতিবৃত্ত: গুলশান থানার ভাটারা মৌজায় সিএস দাগ ৯২৮ ও ৯৪২ নম্বর দাগে বারিধারা দুতাবাস এলাকায় জাতিসংঘ সড়কের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে মরিয়ম টাওয়ারের অবস্থান। প্রস্তাবিত ভুমি এলএ (ল্যান্ড একুজিশন) মামলার (১৩৮/৬১-৬২) মাধ্যমে রাজউক এই জমি অবমুক্ত করেছিল। ১৯৯৩ সালে মরিয়ম টাওয়ার নির্মাণের জন্য মালিক আলম আহম্মদ রাজউকের কাছে ভুমি ছাড়পত্র চাইলে তা দেওয়া হয়। ওই সময় রাজউকের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা লেকের জায়গায় ভবনটি পড়ছে কি না, তা খতিয়ে দেখেনি। ১৯৯৪ সালে মরিয়ম টাওয়ারের ২০ তলা ভবনের নকশা অনুমোদনের জন্য জমির মালিক দাবিদার রাজউকে আবেদন করেন। তখন দুতাবাস এলাকার নিরাপত্তা বিবেচনায় সর্বোচ্চ ছয়তলা ভবন নির্মাণের বিষয়ে নির্দেশনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় রাজউক। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আপত্তি না জানানোয় ২০ তলার স্থলে ১৪ তলা পর্যন্ত ভবনের নকশা অনুমোদন করা হয়। ১৯৯৬ সালে মালিকপক্ষ ২০ তলা নকশার জন্য পুনরায় আবেদন করলে ১৮০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত অনুমোদন করা হয়। রাজউক সুত্র জানায়, ১৮০ ফুটের স্থলে ভবনটি নির্মাণ করা হয় ২১২ ফুট।
নকশায় ত্রুটি: মরিয়ম টাওয়ারের প্রহরী রফিকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এখানে ভবনের মালিক আলম আহম্মদ আসেন কি না। জবাবে তিনি বলেন, কাছাকাছি সময়ে দেখেননি। রাজউকের লোকেরা আসেন কি না−জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে আসতেন না, এখন আসেন এবং বারবার চারদিকে মাপজোখ করেন।
রাজউক মরিয়ম টাওয়ার মাপজোখ করে যা পেয়েছে তাতে দেখা যায়, নকশা অনুযায়ী এই ভবন নির্মাণে দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে জায়গা একেবারেই ছাড়া হয়নি। নকশা অনুযায়ী উত্তর দিকে ১ দশমিক ৫২ মিটার, দক্ষিণে ৩ দশমিক ৬৬ ও ২৪৪ মিটার, পূর্ব দিকে ৯ দশমিক ১৪ মিটার ও ১২৭ মিটার এবং পশ্চিম দিকে ১ দশমিক ২৭ মিটার ছেড়ে নির্মাণ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে উত্তর দিকে ১ দশমিক ৫২ মিটার, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে শুন্য মিটার এবং পশ্চিম দিকে ১ দশমিক ২৫ মিটার ছেড়ে নির্মাণ করা হয়েছে। রাজউকের জরিপকারকের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘সেট ব্যাকের ব্যত্যয় করে আনুভৌমিক সম্প্রসারণপূর্বক আংশিক লেকের মধ্যে ইমারত নির্মাণ করা হয়েছে।’
নকশার বাইরে নির্মাণকাজ করায় রাজউক গত বছরের ১২ মার্চ ও ২৬ জুন মরিয়ম টাওয়ার ফ্ল্যাট ওনার অ্যাসোসিয়েশনকে নোটিশ দেয়। একই বছরের ৪ জুলাই রাজউক জায়গার মালিকের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করে এবং ফ্ল্যাটের মালিকদের আবারও নোটিশ দেওয়া হয়। পরে ২৯ জুলাই ফ্ল্যাটের মালিক মিসেস দিলশাদ করিমের (ফ্ল্যাট নম্বর ১৭-ডি) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ স্থগিতাদেশ জারি করেন।
ফ্ল্যাটের মালিকেরা জানান, ভবনের মালিক আলম আহম্মদ ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি করে দিয়েছেন। মরিয়ম টাওয়ার ফ্ল্যাট ওনার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এস করিম কাইয়ুম প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে লেক দখলের অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা। তবে ভবন নির্মাণে নকশার ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ২০ তলা ভবনটি পাঁচ-ছয় বছর ধরে নির্মাণ করা হয়েছে, অথচ ওই সময় রাজউক কিছু বলেনি।
লেকের সীমানা পরিমাপের স্বার্থে মরিয়ম টাওয়ারের জায়গা রাজউক আবার অধিগ্রহণ করলে তাঁরা কী করবেন−এ প্রশ্নের জবাবে এস করিম কাইয়ুম বলেন, সরকারি সিদ্ধান্তে ভবনটি হয়তো ভেঙে ফেলা হবে। কিন্তু এতে করে তাঁদের ওপর চরম অবিচার করা হবে।
ডিসিসির সড়ক প্রকল্প বিঘ্নিত: মরিয়ম টাওয়ার ও ভরাট করা কিছু প্লটের কারণে বারিধারা লেকপাড়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) ১০ ফুট চওড়া সড়কের জরুরি নির্মাণকাজ থেমে গেছে। বারিধারা দুতাবাস এলাকায় (ডিপ্লোম্যাটিক জোন) নিরাপত্তা বাড়াতে এবং যানবাহনের চাপ কমাতে লেকপাড়ে বিকল্প এই সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে ডিসিসির সম্পত্তি বিভাগ ও প্রকৌশল বিভাগকে খোঁজখবর করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হবে।
বারিধারা লেকে ২০ তলা ‘মরিয়ম টাওয়ার’ বেকায়দায় রাজউক
Labels:
সমাজনীতি