আজকের সমকালের একটি বিশেষ খবর। কারও চোখে পড়েছে কিনা জানিনা, কিন্তু খবরটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
জঙ্গি শনাক্ত করার পরিণামে পদাবনতি
সাতক্ষীরা
ওসি গোলাম মোহাম্মদকে পদাবনতি করে দারোগা করা হয়েছে। জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সাতক্ষীরা সদর আসনের জামায়াতে ইসলামীর সাবেক এমপি মাওলানা আঃ খালেক মণ্ডলের কোপানলে পড়েই তার এই পরিণতি। জোট সরকারের উদ্দেশ্য ছিল ২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট সিরিজ বোমা হামলার দায়-দায়িত্ব তৎকালীন বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। জেএমবিকে আড়াল করাও ছিল সরকারের লক্ষ্য। কিন্তু সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় সিরিজ বোমা হামলার মাত্র চার ঘণ্টার মধ্যে সাতক্ষীরায় সর্বপ্রথম জেএমবি জঙ্গিগোষ্ঠীকে শনাক্ত করার কারণে। আর ওসি গোলাম মোহাম্মদ এই শনাক্তকরণের কাজটি করেছিলেন।সাতক্ষীরা
দুই জেএমবি জঙ্গির স্বীকারোক্তির ভিডিও ফুটেজ দেশ-বিদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচার হওয়ায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শায়খ রহমান ও বাংলাভাইকে আড়াল করতে পারেনি জোট সরকার। এসব কারণেই সাতক্ষীরা সদর থানার তৎকালীন অবাধ্য ওসি গোলাম মোহাম্মদকে দায়ী করা হয়। তিন হাজার টাকা দুর্নীতির অভিযোগে ওসি গোলাম মোহাম্মদকে দারোগা পদে ডিমোশন দেওয়া হয়েছে। আর এই দুর্নীতির অভিযোগের নেপথ্যে ছিলেন জামায়াত সমর্থিত এক ইউপি চেয়ারম্যান। জোট সরকারের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট বেলা ১১টার দিকে দেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালানো হয়। সাতক্ষীরা শহরের সাতটি পয়েন্টে বোমা হামলা চালায় জঙ্গিগোষ্ঠী। সাতক্ষীরা শহরের বাঁকাল ইসলামপুর চরের বাসিন্দা পকেটমার রওশন আলীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সিরিজ বোমা হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় জেএমবি জঙ্গি নাসির উদ্দিন দফাদার। ধৃত নাসিরের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ১৭ আগষ্ট রাত নয়টার দিকে শহরের ইটাগাছা এলাকার বাসিন্দা অপর জঙ্গি মনিরুজ্জামান মুন্নাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। শায়খ রহমান ও বাংলাভাইয়ের নির্দেশে ইসলামী আইন বাস্তবায়নের দাবিতে সিরিজবোমা হামলার দায়-দায়িত্ব স্বীকার করে জেএমবি জঙ্গি নাসির উদ্দিন দফাদার ও মনিরুজ্জামান মুন্না। তৎকালীন সাতক্ষীরা সদর থানার ওসি গোলাম মোহাম্মদ ধৃত দুই জেএমবি জঙ্গির স্বীকারোক্তির ভিডিওচিত্র ধারণ করেন নিজ উদ্যোগে। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও দুই জঙ্গির জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিওচিত্র ধারণ করে সাতক্ষীরায় প্রথম জেএমবি জঙ্গিগোষ্ঠীকে শনাক্ত করার পরও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর চাপে ২০ আগষ্ট পুলিশ হেডকোয়ার্টারের দিকনির্দেশনায় তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সমর্থিত লোকজনকে গ্রেফতার করতে বলা হয়। পুলিশ হেডকোয়ার্টারের এ নির্দেশনা সব থানায় পৌঁছে যায়। কিন্তু ধৃত জেএমবি জঙ্গি নাসির ও মুন্নার স্বীকারোক্তিমহৃলক জবানবন্দি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে (এটিএন বাংলা) প্রচারিত হওয়ার পর বিপাকে পড়েন সদর থানার ওসি গোলাম মোহাম্মদ। পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে তাকে শোকজ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, সিরিজ বোমা হামলার দায়-দায়িত্ব আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপিয়ে জেএমবিকে আড়াল করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয় জোট সরকারের শীর্ষ নেতারা। পর্যায়ক্রমে সিরিজ বোমা হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজন জেএমবি জঙ্গি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃত জেএমবি জঙ্গিরা জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক বলে প্রকাশ পায়। পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ হন স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর জনৈক নেতা। সিরিজ বোমা হামলার দায়-দায়িত্ব স্বীকার করে ছয়জন জেএমবি জঙ্গি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমহৃলক জবানবন্দি প্রদান করে। এরপর পুলিশের বিশেষ শাখার উদ্যোগে সন্দেহভাজন জেএমবি জঙ্গিদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়। ধর্মের নামে উগ্র জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের বিরুদ্ধেদ অভিযান শুরু হলে সদর থানার ওসির ওপর ক্ষেপে যান সাবেক জামায়াত এমপি মাওলানা আঃ খালেক মণ্ডল। সাতক্ষীরা জেলায় তালিকাভুক্ত ১২৯ জেএমবি জঙ্গির বিরুদ্ধে ধর্মের নামে উগ্র জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নেয় পুলিশ। বিষয়টি জামায়াত নেতা আঃ খালেক জানতে পেরে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। সদর থানার তৎকালীন ওসি গোলাম মোহাম্মদ বাদী হয়ে তালিকাভুক্ত ১২৯ জেএমবি জঙ্গিকে আসামি করে ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা করেন। মামলা নং-১০। এ মামলা দায়েরের খবর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হলে চরম ক্ষুব্ধ হন সাবেক জামায়াত এমপি আঃ খালেক মণ্ডল। অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশে ওইদিন রাতেই পুলিশ ১২৯ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা
মামলার এজাহার রদবদল করতে বাধ্য হয়। মামলার নম্বর ঠিক রেখে আসামির তালিকায় ১২৯ জনের পরিবর্তে ১১ জনকে দেখানো হয়। তবে পুলিশ তালিকাভুক্ত জেএমবি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করলে আবারো ক্ষুব্ধ হন জামায়াত নেতা আঃ খালেক। তবে ওই জামায়াত নেতা তালিকাভুক্ত তিন জেএমবি জঙ্গির নাম একটি চিরকুটে লিখে তাদের না ধরার জন্য সদর থানার ওসিকে অনুরোধ করেন। সাবেক জামায়াত এমপির অনুরোধ উপেক্ষা করে পুলিশ তালিকাভুক্ত জেএমবি জঙ্গি সদর উপজেলার তনুইগাছা গ্রামের আশরাফ মাষ্টার (২৬ নং) ও টেংরা গ্রামের রিয়াজ হাজিকে গ্রেফতার করলে তিনি আরো ক্ষেপে যান। অপর তালিকাভুক্ত জঙ্গি সদর উপজেলার তনুইগাছা গ্রামের মাওলানা ওহিকুর রহমান (৩৩ নং) ও কুশখালী গ্রামের আলাউদ্দিন মোড়লকে (২৮ নং) আটক করার জন্য পুলিশ বিরামহীন অভিযান চালাতে থাকলে ২০০৫ সালের ২৪ অক্টোবর সাবেক এমপি আঃ খালেক সদর থানার ওসি গোলাম মোহাম্মদকে অন্যত্র বদলির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার পাঠান। বিভিন্ন সময়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অভিযোগে সাবেক এমপি মাওলানা আঃ খালেকের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর থানায় সাতটি জিডি করে। এরপরও জেএমবি জঙ্গিগোষ্ঠী প্রধান পৃষ্ঠপোষক মাওলানা আঃ খালেক ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতার কারণে। তবে মাওলানা আঃ খালেক পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছেন। তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগকে তিনি ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দিয়েছেন।