কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

bdnews24

‘জাহিদ ভাই’-এর যত কীর্তি!

‘জাহিদ ভাই’-এর যত কীর্তি!
প্রতীক ইজাজ

বিগত জোট সরকারের পাঁচ বছর সার্বক্ষণিক অনুগতদের বৃত্তের মধ্যে থাকতেন তিনি। তার অঙ্গুলি হেলনে চলত পুরো সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত। নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, কেনাকাটা সবকিছুই ছিল তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। ঊনচিল্লশটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের তিনিই ছিলেন প্রধান ব্যক্তি। সরকারি টাকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন বাইশটি দেশ। বিএমএ নির্বাচনে তার ভয়ে তটস্ট’ থাকতেন সিভিল সার্জনরা পর্যন্ত। পরীক্ষা বোর্ডে তাকে না চিনলে উত্তীর্ণ করা হতো না চিকিৎসকদের। তার অবাধ্য চিকিৎসককে হাসপাতালের কক্ষে আটকে রেখে করা হতো মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। এক নজর তাকে দেখা দিতে মধ্যরাত অবধি কোনো না কোনো সমস্যা নিয়ে আগত উমেদার চিকিৎসকদের ভিড় লেগে থাকত নিউ ইস্কাটনের সড়কটিতে।
চিকিৎসক সমাজে পরিচিত ‘জাহিদ ভাই’ সেই ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনকে অবশেষে দুর্নীতির জন্য তের বছরের সশ্রম কারাদেণ্ড দণ্ডিত হতে হলো রোববার। স্বামীকে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করায় তিন বছরের সশ্রম কারাদ- হলো এক সময়ের নার্স স্ত্রী রিফাত হোসেনেরও। দেশের ইতিহাসে চিকিৎসা পেশায় এতটা ন্যক্কারজনক অধ্যায়ের নজির মেলা ভার। তার সংগঠন বিএনপি দলীয় ‘ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (ড্যাব) প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলল চিকিৎসকদের পেশাজীবী রাজনীতিকে।
প্রতাপশালী ডা. জাহিদ বিগত জোট সরকার বিদায় নেওয়ার সময় ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে শুরু হয় তার দুর্নীতির তদন্ত। ওএসডি করা হয় তাকে। তালিকাভুক্ত দুর্নীতিবাজদের ধরপাকড় শুরু হলে গত বছরের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে লাপাত্তা হয়ে যান ডা. জাহিদ।
২০০১ সালের আগে তিনি ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইউরোলজি বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট। ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভাগ্যে জুটে যায় আলাদীনের জাদুর চেরাগ। মাত্র তিন বছরে অনেককে ডিঙিয়ে ২০০৪ সালে সহযোগী অধ্যাপক। তার পরই দ্রুত অধ্যাপক ও বিভাগের চেয়ারম্যান। প্রভাব খাটিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের ডিন।
১৯৮৩ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করা ডা. জাহিদ ছাত্রদল করতেন। ১৯৯০ সালে ড্যাবে যোগদান ও ১৯৯৮ সালে মহাসচিব হন। বিএনপির ভেতরে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের অভিভাবকত্বে ড্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটি চুড়ান্ত হলেও তাকে পাস কাটিয়ে এক রাতে অধ্যাপক বি. চৌধুরীর ইচ্ছায় গঠিত কমিটি পাস হয়। এখনো তিনি ড্যাবের মহাসচিব। পেশাজীবী ডাক্তারদের জাতীয় সংগঠন বিএমএ’র মহাসচিবও হন তিনি পর পর দু’বার। বিএমএ কার্যত এখনো ড্যাব নিয়ন্ত্রিত।
ড্যাব দ্বারা স্বাসথ্য প্রশাসন দলীয়করণ হওয়ার পর সারা দেশের বিএনপিপন্থী, বিএনপির অনুগ্রহপ্রার্থী, সুযোগ সন্ধানী সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের ডাক্তার এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কী নিয়োগ, কী পদোন্নতি, পদায়ন, অন্য কাউকে ল্যাং মারা, উন্নয়ন বা কেনাকাটার দরপত্রে কাউকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়াসহ সব কাজে আসতেন ডা. জাহিদের কাছে। সেই থেকে নিউ ইস্কাটনে রাস্তার এপাশে ড্যাব কেন্দ্রীয় কার্যালয়- ওপাশে তার ‘উদয়ন পলি ক্লিনিক’ এবং তোপখানা রোডের বিএমএর অফিসে গভীর রাত পর্যন্ত তিনি ‘কাজ’ করতেন। সংশ্লিরা জানেন এবং জানান যে সে কাজ হচ্ছে তদ্বির। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, যে কোনো কাজ বাগাতে সবার মুখে আওয়াজ কেবল জাহিদ ভাই, জাহিদ ভাই, জাহিদ ভাই! না চিনলেও পরিচিত কাউকে ধরে জাহিদ ভাইয়ের কাছে পৌঁছানো চাই মনোবাঞ্ঝা পূরণের জন্য।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বিধি অনুযায়ী সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক ও তা থেকে অধ্যাপক হতে নূন্যতম ১৩ বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা, এফসিপিএস, এমএস বা এমডি ডিগ্রি এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রে আইএসও ও বিএমডিসি স্বীকৃত জার্নালে তিন থেকে পাঁচটি প্রকাশনা থাকতে হবে। কিন্তু এসব নিয়মকানুন কিছুই মানতে হয়নি ডা. জাহিদকে। এ ধরনের পদোন্নতি বৈধ করতেই সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ এসআরও জারির মাধ্যমে ‘ওয়ান টাইম রিলাক্সেশন’ নামে একটি নতুন অর্ডিন্যান্স করা হয়। অধ্যাদেশটি বিএনপিতে স্বজনপ্রীতির ম্যাগনাকার্টা হয়ে ওঠে।
পাঁচ বছর আগে জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. জাহিদ থাকতেন রাজধানীর দিলু রোডে একটি ভাড়া বাড়িতে। নিজের পেশা ও নার্স স্ত্রী আয় দিয়ে চলত সংসার। আর পরে? স্ত্রী রিফাত হোসেন ব্যবসায়ী ও শিল্কপ্পপতি। ক্ষমতাধর এ দম্পতি কোটি টাকার সংসদ, ফ্ল্যাট, বাড়ি-গাড়ি, বিপুল অগ্ধেকর অর্থ ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। সিদ্বেশ্বরী রোডে মনোয়ারা হাসপাতালের পেছনে বহুতল একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে তাদের। ডেল্টা টিভি নামে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল চালু করার সব প্রস্তুতিও শেষ করে এনেছিলেন তিনি।
ময়মনসিংহের ব্রাক্ষপল্লী পাড়ায় বাবার সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘দেশ বাংলা ফাউন্ডেশনে’র ছাতায় এখনো চলছে ডা. জাহিদের তিনটি বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে ঢাকার মহাখালীর নিউ ডিওএইচএসের ৩৪ নম্বর সড়কে ৫০০ নম্বর বাড়িতে ডেল্টা ফার্মা লিমিটেড, ডেল্টা হারবাল লিমিটেড ও ডেল্টা ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড। এগুলোর প্রত্যেকটিরই প্রধান হয় ডা. জাহিদ নতুবা তার স্ত্রী রিফাত।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের লটারি কেলেগ্ধকারি ছিল দুর্নীতির আরেকটি চিত্র। ২০০৪ সালের প্রথমদিকে হাসপাতালটি শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ওই লটারির আয়োজন করেছিল। হাসপাতালের প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টিকিট কেনার নামে বিশেষ কমিশনের মাধ্যমে প্রায় ২৫ লাখ টাকা প্রথমে হাতিয়ে নেন তিনি। এরপর বিশেষ কৌশলে লটারির প্রথম পুরস্কারের ৩০ লাখ টাকাও হাতিয়ে নেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের টাস্ক ফোর্স ঘটনাটির তদন্ত করছে।
দলবাজি করতে গিয়ে দেশের চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থাকেও তছনছ করে দিয়েছেন ডা. জাহিদ। দলীয়দের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ তৈরি করতে গিয়ে ২০০২ সালের জানুয়ারি থেকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিভাবে দেশের আটটি মেডিকেল কলেজে পাঁচ বছরের পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স (এমএস, এমডি ও এমফিল ডিগ্রি) চালু করতে সরকারকে বাধ্য করেন। কোনো নিয়মনীতি না মেনেই ভর্তি করান দলীয় ৫০ চিকিৎসককে। সরকার ঘটনার তদন্তে সত্যতার প্রমাণ পেয়েছে। জোট সরকার বিদায় নেওয়ার আগে ও পরের দু’মাস বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে বিশ্ব ব্যাংকের টাকায় দলীয় দু’শ’ চিকিৎসককে প্রমোদ ভ্রমণে পাঠান ডা. জাহিদ। ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পিএসসি পরীক্ষায় দশ দলীয় চিকিৎসককে পদোন্নতি দিতে বাধ্য করেন তিনি।
সরকারের শেষ সময়ে এসে ভূমিদস্যুতায় নেমে পড়েছিলেন ডা. জাহিদ। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার টেপিরবাড়ি গ্রামের ৯নং টেপিরবাড়ি মৌজার ৩০ বিঘা জমি দখল করে নিয়েছেন তিনি মা জেবুন্নেসার নামে। পরে এ নিয়ে ওই এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে তিনি জমিটি তার প্রতিষ্ঠান ডেল্টা ফার্মার নামে দলিল করে দিয়েছেন। দুদকে জমা দেওয়া সম্পত্তির তালিকায় এ জমির কথা উল্লেখ নেই।
পেশায় ডাক্তার, অথচ কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য নিজের পেশা ও উপাধি গোপন করে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন মুদি দোকানদার। গত আট বছর সরকারকে একটি পয়সাও কর দেননি তিনি। ১৯৯০-৯১ সালে খোলা আয়কর ফাইলে তিনি নিজেকে মুদি ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ করেন। ঠিকানা বদলান তিন বার। এ সময় তার বকেয়া করের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা।
সমকাল। ২৬ মে ২০০৮

BBC Asia-Pacific

CNN.com - Asia