চার দলে ১৭, মহাজোটে দুই, স্বতন্ত্র দুজন
ওয়াসেক বিল্লাহ্
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা, গণহত্যা এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত অন্তত ২১ জন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। তাঁদের ১৬ জন জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী। বিএনপির একজন। আর দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির আরও দুজন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে মনোনয়ন পেয়েছেন দুজন স্বাধীনতাবিরোধী।
২০০৭ সালের বাতিল হওয়া নির্বাচনেও বেশ কয়েকজন স্বাধীনতাবিরোধী চারদলীয় জোটের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তবে সে সময় মহাজোটে এমন কেউ ছিলেন না। গত ১৬ মে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর আওয়ামী লীগের মুখপাত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, স্বাধীনতাবিরোধী কেউ যেন ভবিষ্যতে দলের মনোনয়ন না পান, সে বিষয়ে তাঁরা সতর্ক থাকবেন।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ্ প্রথম আলোকে বলেন, "আওয়ামী লীগ আমাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে ওয়াদা করেছিল, তারা যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে আঁতাত করবে না, স্বাধীনতাবিরোধীদের মনোনয়ন দেবে না। কিন্তু তারা ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। এর জবাব জনগণ দেবে।"
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনা করবেন।
জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী প্রার্থীরা: পাবনা-১ আসনে প্রার্থী হয়েছেন জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান আলবদর বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন (সুত্র: এ এস এম সামছুল আরেফিনের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান, পৃ-৪২৭)। ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এ "বদর দিবস: পাকিস্তান ও আলবদর" শিরোনামে একটি উপসম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছিলেন, "...শুধু পাকিস্তান রক্ষার আত্মরক্ষামূলক প্রচেষ্টা চালিয়েই এ পাকিস্তানকে রক্ষা করা যাবে না।"
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ আলবদর বাহিনীর কেন্দ্রীয় সংগঠক ছিলেন। তিনি এবার ফরিদপুর-৩ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ১৭ অক্টোবর রংপুরে পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের এক সভায় তিনি আলবদর বাহিনী গড়ে তুলতে দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেন (সুত্র: ফোর্টনাইটলি সিক্রেট রিপোর্ট অন দ্য সিচুয়েশন ইন ইস্ট পাকিস্তান)।
শেরপুর-১ আসনে জামায়াতের প্রার্থী হয়েছেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট দৈনিক সংগ্রাম-এর একটি প্রতিবেদনে তাঁকে ময়মনসিংহ জেলা আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
রংপুর-২ আসনের প্রার্থী জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি এ টি এম আজহারুল ইসলাম আলবদর বাহিনীর রাজশাহী জেলা শাখার প্রধান ছিলেন। ফোর্টনাইটলি সিক্রেট রিপোর্ট অন দ্য সিচুয়েশন ইন ইস্ট পাকিস্তানে এ টি এম আজহার মুক্তিযোদ্ধাদের শায়েস্তা করতে তৎপর ছিলেন বলে উল্লেখ আছে।
নির্বাহী পরিষদের সদস্য পাবনা-৫ আসনে চার দলের প্রার্থী মাওলানা মোহাম্মদ সুবহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনার শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন (মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান, পৃ-৪১১)। পাবনার একাধিক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জানান, একাত্তরের জুন মাসে মাওলানা সুবহানের নেতৃত্বে পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মাওলানা কাসিমউদ্দিনকে হত্যা করে শান্তি কমিটি। তাঁরা জানান, স্বাধীনতার ৩৫ বছর পরও মাওলানা সুবহানকে তাঁরা ভয় করেন।
নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী চট্টগ্রাম জেলা আলবদর বাহিনীর প্রধান রাজাকার বাহিনীর প্রধান ও আলবদর বাহিনীর কেন্দ্রীয় সংগঠক ছিলেন। তিনি ঢাকা-৮ আসনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ২ আগস্ট চট্টগ্রামের মুসলিম হলে এক সমাবেশে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ করে বলেন, "গ্রামগঞ্জের প্রতিটি এলাকায় খুঁজে খুঁজে শত্রুর শেষচিহ্ন মুছে ফেলতে হবে (সুত্র: দৈনিক সংগ্রাম)।"
পিরোজপুর-১ আসনে জামায়াতের প্রার্থী (নির্বাহী কমিটির সদস্য) দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীও স্বাধীনতাবিরোধী একজন চিহ্নিত ব্যক্তি।
আমাদের গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধা-১ আসনে জামায়াতের প্রার্থী ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার রাজাকার বাহিনীর সদস্য আবু সালেহ মোহাম্মদ আবদুল আজিজ মিয়া রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন সুন্দরগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লায়েক আলী খান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কের মাঠের হাটসংলগ্ন সেতু পাহারা দেওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধা মনে করে একটি ঘোড়াকে গুলি করে মেরে ফেলেন। এর পর থেকে এলাকায় তাঁর নাম হয় "ঘোড়া মারা আজিজ"।
সাতক্ষীরার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক এনামুল হক বিশ্বাস প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, সাতক্ষীরা-২ আসনের প্রার্থী মোহাম্মদ আবদুল খালেক নৃসংশতার জন্য "জল্লাদ খালেক" বলে পরিচিত ছিলেন। এপ্রিল মাসে আবদুল আজিজ সাতক্ষীরা শহরে পুলিন বিহারী ব্যানার্জির বাড়ি দখল করে নেন। যুদ্ধের পর তিনি পালিয়ে যান।
সাতক্ষীরা-৩ আসনে জামায়াতের প্রার্থী এম রিয়াসত আলী বিশ্বাস ছিলেন আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের শান্তি কমিটির সেক্রেটারি। আশাশুনি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিয়ার রহমান বলেন, "একাত্তরের আগস্ট মাসে তাঁকে ধরে আনেন এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু রোজার মাস হওয়ায় আমি তাঁকে হত্যা না করে বাসায় দিয়ে এসেছিলাম। তখন সে কথা দিয়েছিল আর রাজাকার থাকবে না; কিন্তু ওই কথা রাখেনি।"
শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর কেন্দ্রীয় সংগঠক শাহ্ মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস (মুক্তিযুদ্ধে ব্যক্তির অবস্থান, পৃ-৪২৮) মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন খুলনা-৬ আসনে। ঠাকুরগাঁওয়ের আলবদর বাহিনীর সদস্য মাওলানা আবদুল হাকিম মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ঠাকুরগাঁও-২ আসনে।
চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা হাবিবুর রহমানও শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন বলে চুয়াডাঙ্গার গেরিলা কমান্ডার আবদুল হান্নানের স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃহত্তর কুষ্টিয়া বইয়ের ১৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে।
সিলেট বিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল প্রথম আলোকে জানান, সিলেট-৫ আসনে জামায়াতের প্রার্থী ফরিদউদ্দিন চৌধুরী আলবদর বাহিনীর সদস্য ছিলেন। সিলেট-৬ আসনে জামায়াতের প্রার্থী হাবীবুর রহমান তখন জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ করতেন।
কক্সবাজার-১ আসনে জামায়াতের প্রার্থী এনামুল হক মঞ্জু মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন ও আলবদরের প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন (সুত্র: একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়, পৃ-১৪৬)।
বিএনপির তিনজন: চট্টগ্রাম-৬ আসনে বিএনপির প্রার্থী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী একাত্তরের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সমাজসেবী নতুন চন্দ্র সিংহ হত্যাকান্ডে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। সেদিন নতুন চন্দ্রকে তাঁর বাড়ি কুন্ডেশ্বরী ভবন থেকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসেন সাকা চৌধুরী। এরপর পাকিস্তান বাহিনীর একজন মেজর তাঁকে গুলি করেন। পরে সাকা চৌধুরী তাঁকে তিনটি গুলি করেন। একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায় বইয়ে এ তথ্য রয়েছে।
বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে জয়পুরহাট-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আবদুল আলীম। তাঁর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিদের সারিতে দাঁড় করিয়ে নিজের হাতে গুলি করে মারার অভিযোগ আছে। তিনি ছিলেন শান্তি কমিটির অন্যতম সংগঠক ও জয়পুরহাট মহকুমার চেয়ারম্যান ( সুত্র: একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়)। গত ৪ নভেম্বর সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীর তালিকাতেও আবদুল আলীমের নাম আছে।
ভোলা-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন মোশারেফ হোসেন শাজাহান। তিনি "৭০-এ প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হয়েও মুক্তিযুদ্ধের সময় দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
মহাজোটের দুজন ও আরেকজনকে নিয়ে প্রশ্ন: পিরোজপুর-৩ থেকে মহাজোটের মনোনয়ন পেয়েছেন জাতীয় পার্টির আবদুল জব্বার। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মঠবাড়িয়ায় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন মঠবাড়িয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার এ ইউ এম নাছিরউদ্দিন। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের পর পর জব্বার এলাকা থেকে পালিয়ে যান। সে সময় তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মামলাও হয়। তাঁর মনোনয়ন বদলের দাবিতে মঠবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মানববন্ধনসহ নানা কর্মসুচি পালন করেছে।
যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে মহাজোটের মনোনয়ন পেয়েছেন জাতীয় পার্টির মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন। তিনি ১৯৯১ সালে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে এ আসন থেকে জয়ী হন। কেশবপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার কাজী রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, "সাখাওয়াত হোসেন একজন কুখ্যাত রাজাকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে কেশবপুরের মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, লুট করেছে।" সাখাওয়াতের মনোনয়ন বদলের দাবিতেও কেশবপুরে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন।
নীলফামারী-৩ (জলঢাকা) আসনে জাতীয় পার্টি ও মহাজোটের প্রার্থী ফারুক কাদেরের প্রয়াত বাবা মুসলিম লীগের নেতা কাজী কাদের স্বাধীনতাবিরোধীদের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর সরকার তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল। সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় কাজী কাদেরের নাম আছে। তাঁর ছেলেকে মহাজোটের মনোনয়ন দেওয়ায় সিদ্ধান্ত বদলের দাবিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্বজনেরা কালীগঞ্জ বধ্যভুমির সামনে মানববন্ধন করেছেন।
প্রথম আলো, ০৬ ডিসেম্বর, ২০০৮