কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

bdnews24

কাগজে-কলমে বদলেছে জামায়াত

* গঠনতন্ত্রে আল্লাহ্র আইন ও সৎ লোকের শাসন বাদ
* প্রচ্ছদে আল্লাহ্ ও আক্বিমুদ্দীন নেই
* অমুসলিমরা সহযোগী সদস্য হতে পারবে
* দলের নাম পরিবর্তন ও নারী সদস্য থাকবে
- ওয়াসেক বিল্লাহ্
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য জামায়াতে ইসলামী তাদের গঠনতন্ত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। জামায়াতের গঠনতন্ত্রের প্রচ্ছদে "আল্লাহ্" ও "আক্বিমুদ্দীন", অর্থাৎ "তোমরা দ্বীন (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা কর"−এই লেখাসংবলিত লোগো ছিল। কিন্তু গতকাল নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া সংশোধিত গঠনতন্ত্রে এটি বাদ দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিনের আদর্শিক অবস্থান ত্যাগ করে অমুসলিমদেরও দলে নেওয়ার নীতি নিয়েছে দলটি।
এ ছাড়া দলের নাম জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ থেকে "বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী" করা হয়েছে।
দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে একটি অনুচ্ছেদও বাদ দেওয়া হয়েছে গঠনতন্ত্র থেকে। আগের গঠনতন্ত্রের ধারা ৩-এর ব্যাখ্যায় বলা ছিল, "জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর দৃষ্টিতে দ্বীন ও ইসলামী জীবন বিধান একই অর্থবোধক পরিভাষা। তাই ইসলামী জীবন বিধান কায়েম করাই কুরআন মজীদে ব্যবহূত "ইকামাতে দ্বীন" পরিভাষাটির সঠিক অর্থ।" নতুন গঠনতন্ত্রে এই ব্যাখ্যা নেই।

সংশোধিত গঠনতন্ত্রে আল্লাহ্র আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েমের বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। আগের গঠনতন্ত্রের ৫ ধারার ৩ উপধারায় ছিল, "সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহ্র আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েম করিয়া সমাজ হইতে সকল প্রকার জুলুম, শোষণ ও অবিচারের অবসান ঘটানোর আহ্বান।"

সংশোধিত গঠনতন্ত্রে একই ধারায় বলা হয়েছে, "সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামের সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম করিয়া সমাজ হইতে সকল প্রকার জুলুম, শোষণ, দুর্নীতি ও অবিচারের অবসান ঘটানোর আহ্বান।"
গঠনতন্ত্রের ধারা-৬(২) থেকে "জাহিলিয়াতের যাবতীয় চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ" বাক্যাংশটিও বাদ দিয়েছে জামায়াত।

গঠনতন্ত্রে গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কথাগুলো একাধিক জায়গায় সংযুক্ত করা হয়েছে। আগের গঠনতন্ত্রে শব্দ দুটি ছিল না।

এত দিন জামায়াতের কোনো কমিটিতেই নারী সদস্যদের না রাখা হলেও নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনের শর্ত মেনে সব কমিটিতে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য সম্পৃক্ত করারও ঘোষণা দিয়েছে দলটি। এর মধ্যেই কেন্দ্রীয়, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন এবং পৌরসভা পর্যায়ে অধিকাংশ কমিটিতে প্রায় ২৫ শতাংশ নারী সদস্য সম্পৃক্ত করা হয়েছে বলেও সংশোধিত গঠনতন্ত্রের পরিশিষ্টে উল্লেখ করা আছে।

তবে নির্বাচন কমিশনের বিধান অনুযায়ী নিবন্ধনের জন্য গঠনতন্ত্রে যেসব বিধানের উল্লেখ থাকতে হবে, সেগুলোর সব শর্ত দলটি পূরণ করতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের বিধান অনুযায়ী দলের সব পর্যায়ের কমিটি নির্বাচিত হতে হবে। কিন্তু সংশোধিত গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা ও মহিলা বিভাগের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরায় সদস্য মনোনয়নে দলের আমিরের ক্ষমতা বহাল রাখা হয়েছে।

নিবন্ধন আইন ও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের সঙ্গে দলীয় গঠনতন্ত্রের অসামঞ্জস্য খুঁজে বের করতে গত ঈদের পর থেকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ করে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী একটি খসড়া গঠনতন্ত্র গতকাল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদনের সঙ্গে জমা দেওয়া হয়েছে। এই গঠনতন্ত্রের পরিশিষ্টে বলা আছে, "৯ম জাতীয় সংসদ অধিবেশন বসার পর ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নির্ধারিত ফোরামে উক্ত প্রস্তাবনা বিবেচনা করিয়া অনুমোদন করা হইবে।"
তবে গঠনতন্ত্র সংশোধনে শুধু দল নিবন্ধনের বিষয়টিই প্রাধান্য পায়নি; দলের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

সবকিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া: দলের সংশোধিত গঠনতন্ত্রের প্রচ্ছদের রং পরিবর্তন করা হয়েছে। অন্তত ১৩টি ধারায় সংশোধন, কয়েকটি ধারা ও অনুচ্ছেদ সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়েছে।

সংশোধিত গঠনতন্ত্রে ধারা ১-এ দলের নাম বদলে "বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী" করা হয়েছে। নাম নিয়ে এক ধরনের সমালোচনার জন্য এটা করা হয়েছে বলে দলের একজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।
অবিভক্ত ভারতে ১৯৪০-এর দশকের শুরুতে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠা। দেশভাগের পর পাকিস্তানে "জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান" এবং ভারতে "জামায়াতে ইসলামী ইনডিয়া" নামে দুটি দল কাজ করে। জর্ডানেও জামায়াতে ইসলামী নামে দল আছে। বাংলাদেশে কাজ শুরু করে "জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ" নামে।

অভিযোগ আছে, জামায়াতে ইসলামী একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং বাংলাদেশের জামায়াত তারই শাখা। এই সমালোচনা বন্ধ করতেই নাম পাল্টানো হলো।

আবার সংশোধিত গঠনতন্ত্রের ভুমিকাতে একটি অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, "যেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ এবং বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়া বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করিয়াছে; সেহেতু এই মৌলিক বিশ্বাস ও চেতনার ভিত্তিতে ইসলামী সমাজ গঠনের মহান উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী−এর এই গঠনতন্ত্র প্রণীত ও প্রবর্তিত হইল।"

অমুসলিমেরাও সদস্য হতে পারবে: সংশোধিত গঠনতন্ত্রে ধারা ১০-এ বলা হয়েছে, "বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিক বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ও কর্মসুচীর সহিত একমত পোষণ করিলে তিনি জামায়াতের সহযোগী সদস্য হইতে পারিবেন।"

জামায়াতের গঠনতন্ত্রে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের একটি করা হয়েছে ধারা ১১-তে। এই ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, "বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি ও অর্থনৈতিক কর্মসুচীর সহিত একমত পোষণ করিলে যে কোনো অমুসলিম নাগরিক ইহার সহযোগী সদস্য হইতে পারিবেন।"

তবে এ জন্য তিনটি শর্ত রেখেছে দলটি। এগুলো হলো: দলের নিয়মশৃঙ্খলা বা সিদ্ধান্তসমূহ নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলা, দলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য একনিষ্ঠ ভুমিকা পালন।

আগের গঠনতন্ত্রের ধারা ১১-তে বলা ছিল, "...তিনি দ্বীন ইসলাম কায়েমের প্রচেষ্টায় শরীক হওয়ার উদ্দেশ্যে জামায়াতের সহযোগী সদস্যরূপে কাজ করিতে পারিবেন।"

স্থায়ী কর্মনীতি ও উদ্দেশ্যে পরিবর্তন: আগের গঠনতন্ত্রের ধারা ৪-এ দলের তিনটি স্থায়ী কর্মনীতির উল্লেখ ছিল। এর তৃতীয়টিতে বলা ছিল, "জামায়াত উহার বাঞ্ছিত সংশোধন ও বিপ্লব কার্যকর করিবার জন্য নিয়মতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করিবে।" এই বাক্যে নিয়মতান্ত্রিক শব্দের পর "গণতান্ত্রিক" শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আবার "বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করিবার লক্ষ্যে" এই বাক্যাংশ সংযোজন করা হয়েছে।

সংশোধিত গঠনতন্ত্রে দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে একটি অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়েছে। এতে বলা আছে, "সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের আদর্শ সমুন্নত রাখা এবং ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তার বিধান এবং সর্ব শ্রেণীর মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, জানমাল ইজ্জতের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, সম্পদের সুষম বণ্টন, জাতীয় আয় ও উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মানুষের জীবনমান উন্নতকরণের মাধ্যমে শোষণ, দুর্নীতি, সন্ত্রাসমুক্ত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো।"

ধারা ৯-এ সদস্যদের (রুকন) দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে একটি উপধারার সংযোজন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, "দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকিবেন।"

কমিটি নির্বাচিত হবে: সংশোধিত গঠনতন্ত্রের ২৩(ক) ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য এবং ১৫ জনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মজলিশে শুরার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। আবার এখন থেকে কেন্দ্রীয় মহিলা কর্মপরিষদের সদস্যরা জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য হবেন। আগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সঙ্গে পরামর্শ করে জামায়াতের আমির দলের এই দুই কমিটি গঠন করতেন।

সব শর্ত মানা হয়নি: দল নিবন্ধন আইনে বলা হয়েছে, "নিবন্ধনে আগ্রহী রাজনৈতিক দলের দলীয় গঠনতন্ত্রে এইরূপ সুষ্কপষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যে, ক. গণতান্ত্রিক রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী দল পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সকল পর্যায়ের কমিটির সদস্য নির্বাচিত হইবে।"

কিন্তু জামায়াতের সংশোধিত গঠনতন্ত্রের ১৮ [৪(চ)] ধারায় বলা আছে, "আমীরে জামায়াত কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সহিত পরামর্শ করিয়া প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্যকে (রুকন) কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য মনোনীত করিতে পারিবেন, যাহাদের মোট সংখ্যা কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার নির্বাচিত সদস্যগণের ১৫% এর অধিক হইবে না।"

আবার ৫৩[ক(৪)] ধারায় বলা আছে, "আমীরে জামায়াত মহিলা মজলিসে শুরার সহিত পরামর্শ করিয়া মহিলা মজলিসে শুরার সদস্য মনোনীত করিতে পারিবেন যাহাদের সংখ্যা নির্বাচিত সদস্যগণের শতকরা ২৫ ভাগের বেশি হইবে না।"
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচিত কমিটিতে মনোনয়ন দিলে সমস্যা কোথায়। যদি থাকে সেটি নির্বাচন কমিশন দেখবে।
অন্যান্য: আগের গঠনতন্ত্রে "বাইতুল মাল" শিরোনামে ষষ্ঠ অধ্যায়ে দলের তহবিলের চারটি উৎসের কথা বলা ছিল। কিন্তু সংশোধিত গঠনতন্ত্রে তহবিলের উৎস হিসেবে রাখা হয়েছে তিনটিকে। "জামায়াতের মালিকানাধীন সম্পত্তির আয়"কে এখন থেকে দলের আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হবে না।

আবার আগের গঠনতন্ত্রের ধারা ১৮-তে ছিল, "আমীরে জামায়াতকে সহযোগিতা ও পরামর্শদানের জন্য একটি মজলিসে শুরা থাকিবে।" এটি সংশোধন করে বলা হয়েছে, "নীতি নির্ধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি মজলিসে শুরা থাকিবে।"
প্রথম আলো, ২১ অক্টোবর, ২০০৮

BBC Asia-Pacific

CNN.com - Asia