কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

bdnews24

বিএনপি-জামায়াতের ত্রিমুখী আচরণ

হারুন আল রশীদ

নির্বাচনী আইন সংশোধন প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান তিন ধরনের। আদালতে মামলা দায়েরের সময়ে এক রকম, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে আরেক রকম এবং প্রকাশ্যে একবারে অন্যরকম। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, জামায়াতের যে ত্রিমূর্তি আচরণ, তার অন্ধ অনুসারী হয়ে পড়েছে বিএনপি।

বিএনপি ও জামায়াত সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের মধ্যে সরকার, আদালত ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে যেসব দাবি-দাওয়া পেশ করেছে, সেসব দাবির একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো মিল নেই। তারা আদালত এবং ইসির কাছে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সুনির্দিষ্ট কিছু বিধান বাতিলের দাবি জানালেও বাইরে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সব বিধান বাতিলের দাবি জানিয়ে যাচ্ছে। ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচন করতে আপাতত সংশোধিত আইন বাতিল বা এ আইনে নতুন করে সংশোধনী আনা সম্ভব নয় জানার পরও তারা সরকার ও ইসির সঙ্গে দরকষাকষির চেষ্টা করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা বর্তমান সরকারের আইন সংশোধনের এখতিয়ার নিয়েও প্রশু তুলেছে। ইসির মতে, বিএনপি ও জামায়াত আসলে কী চায় তা তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। যে কারণে বর্তমানে বিএনপি ও জামায়াতের দাবি-দাওয়া তাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।

জামায়াত ২৮ আগস্ট গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন দাখিল করে। এতে ২০২০ সালের মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ ভাগ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা (ধারা ৯০-বি/১/বি/২), ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক সমন্বয়ে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন না করার বিধান (ধারা ৯০-বি/বি/৩), প্রবাসে দলের শাখা সংগঠন না রাখার বিধান (৯০-সি/ডি) এবং গঠনতন্ত্রে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও লিঙ্গ ভেদে কোনো বৈষম্য না রাখার বিধান (৯০-সি (১/বি) বাতিলের দাবি জানায়। একই সঙ্গে তারা সংবিধানের ৫৮-ঘ/১ অনুচ্ছেদের উল্লেখ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন সংশোধনের এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তোলে।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন সমকালকে বলেন, ‘জামায়াত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ধর্ম, বর্ণ সংক্রান্ত (৯০-সি ১/বি) বিধান বাতিলের যে দাবি জানিয়েছে, তা সংবিধানের সঙ্গে মিল আছে বলেই আমরা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে অন্তর্ভুক্ত করেছি। একই বিধান সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদেও রয়েছে।’

ইসির তৃতীয় দফা সংলাপ শুরু হওয়ার পর ৭ সেপ্টেম্বর বিএনপি এবং ৮ সেপ্টেম্বর জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট ইসিকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, অর্থহীন সংলাপে তারা অংশ নেবে না। খালেদা জিয়ার মুক্তির পর হঠাৎ করেই বিএনপি তাদের মত পাল্টে সংলাপে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিএনপির এ সিদ্ধান্তেরর পর জামায়াত এবং ইসলামী ঐক্যজোটেরও সুর পাল্টে যায়। তারাও সংলাপে অংশ নেওয়ার আগ্রহ জানিয়ে ইসিকে চিঠি দেয়।

২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সংলাপে জামায়াত এবং ইসলামী ঐক্যজোট ইসির কাছে লিখিত প্রস্তাব দাখিল করলেও বিএনপির পক্ষ থেকে তা করা হয়নি। ইসির কাছে মৌখিক প্রস্তাব দিয়েছে তারা। তবে তিনটি দলেরই প্রস্তাব ছিল অভিন্ন।

ইসিতে দাখিল করা জামায়াতের লিখিত দাবির সঙ্গে ২৮ আগষ্ট আদালতে দাখিল করা দাবির কিছুটা অমিল রয়েছে। বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট সুস্পষ্টভাবে গণপ্রতনিধিত্ব আদেশের তিনটি বিশেষ ধারাসহ আরো একাধিক ধারা বাতিল অথবা ক্ষেত্রবিশেষ সংশোধনের দাবি জানায়। বিশেষ তিনটি ধারা হলো- ধারা ৯০-বি/১/বি/২, ৯০-সি (১/এ) ও ৯০-সি (১/বি)।

৯০-বি/১/বি/২ ধারা মতে, রাজনৈতিক দলের সব স্তরের কমিটিতে ৩৩ ভাগ নারীর প্রতিনিধিত্ব আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০-সি (১/এ) ধারায় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্তে বলা হয়েছে, দলীয় গঠনতন্ত্রের উদ্দেশ্যসমূহ সংবিধানের পরিপন্থী হতে পারবে না।

৯০-সি (১/বি) ধারায় বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও লিঙ্গভেদে কোনো বৈষম্য থাকতে পারবে না।

কিন্তু ওইদিন সংলাপ শেষে তিনটি দলই বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের জানায়, তারা সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ পুরোটাই বাতিলের দাবি জানিয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে একজন নির্বাচন কমিশনার ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘সবই যদি বাতিল করতে হয়, তাহলে সংলাপে বসে অহেতুক আমাদের সময় নষ্ট করা হলো কেন?’

একই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ড. এটিএম শামসুল হুদা ২২ সেপ্টেম্বর দুঃখ ও বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘হায় আল্লাহ... ইয়া রাহমানুর রাহিম, পবিত্র মাহে রমজানে জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটের হুজুরদের মুখে এ আমি কী শুনিতে পাইলাম!’ বিস্ময়ের কারণ, আগের দুটি সংলাপে জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট আমাদের সিংহভাগ সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করলেও তৃতীয় দফা সংলাপে তারা সব ধরনের সংস্কারই নাকচ করে দিয়েছে।

ইসির মতে সংবিধানের ৯৩/১ অনুচ্ছেদ অনুসারে বর্তমান সরকারের আইন প্রণয়ন এবং সংশোধন করার এখতিয়ার রয়েছে। সংবিধানের ৯৩/১ অনুচ্ছেদে বলা আছে- ‘সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়া অবস্থায় অথবা উহার অধিবেশন ব্যতীত কোন সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্টি’তি বিদ্যমান রহিয়াছে বলিয়া সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে, তিনি উক্ত পরিস্থিতিতে যেরূপ প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে করিবেন, সেইরূপ অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করিতে পারিবেন এবং জারি হইবার সময় হইতে অনুরূপভাবে প্রণীত অধ্যাদেশ সংসদ আইনের ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন হইবে।’

ইসি ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংশোধনের বিষয়টিকেও নজির হিসেবে দেখছে। ২০০১ সালের ৮ আগস্ট গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ সংশোধন করে গেজেট জারি করা হয়। তখন বিএনপি ও জামায়াত ওই সংশোধনীকে সাধুবাদ জানিয়েছিল। অপরদিকে আপত্তি জানিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ১২ আগস্ট তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমান, ১৩ আগস্ট সিইসি এম সাঈদ এবং ১৪ আগস্ট রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন সংক্রান্ত গেজেট বাতিলের দাবি জানায়। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ তা আমলে নেয়নি।

নির্বাচন কমিশনারদের মতে, ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন সংশোধন করতে পারলে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার পারবে না কেন? যে কারণে বিএনপি-জামায়াতের দাবিকে তারা পুরোপুরি অযৌক্তিক বলে মনে করছেন।

আদালত এবং ইসির বাইরে বিএনপি ও জামায়াত সরকারের সঙ্গে যে ধরনের দরকষাকষি করে যাচ্ছে তাকেও অযৌক্তিক বলে মনে করছে ইসি। সরকারের কাছে তারা যেসব দাবি-দাওয়া রেখে যাচ্ছে, তার সঙ্গে আদালত ও ইসির কাছে রাখা দাবির যথেষ্ট অমিল রয়েছে। যে কারণে ইসি মনে করে বিএনপি ও জামায়াতের দাবি সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নয়।

এ অবস্থায় ইসি আপাতত বিএনপি ও জামায়াতের দাবি আমলে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সূত্র জানিয়েছে, এ বিষয়ে ইসি থেকে সরকার পক্ষকে সুস্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচন এবং ১ অথবা ২ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হলে নির্বাচনী আইনে আর কোনো ধরনের সংশোধনী আনা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নিতে হলে বিএনপি-জামায়াতসহ তাদের অন্য দুই শরিক দলকে আগামীকালের মধ্যেই দলের নাম নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হবে।

BBC Asia-Pacific

CNN.com - Asia