কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

bdnews24

মাদ্রাসাছাত্রদের হুমকির মুখে বিমানবন্দরের সামনে নির্মাণাধীন ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হচ্ছে

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: বাংলার চোখ
কওমি মাদ্রাসার কয়েক শ ছাত্রের হুমকির মুখে নির্মাণাধীন ভাস্কর্য সরিয়ে নিচ্ছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। বিমানবন্দরের সামনে ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করতে "বিমানবন্দর গোলচত্বর মূর্তি প্রতিরোধ কমিটি"র ব্যানারে মাদ্রাসার ছাত্রদের সংগঠিত করেন খতমে নবুওয়ত আন্দোলনের আমির মুফতি নুর হোসাইন নুরানী।
ভাস্কর মৃণাল হক জানান, স্থানীয় বাবুস সালাম মসজিদ ও মাদ্রাসার আপত্তির মুখে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে গতকাল বুধবার দুপুর থেকে তাঁর নির্মিত ভাস্কর্য পাঁচটি কেটে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়। দেশীয় বাদ্যযন্ত্র হাতে পাঁচ বাউল এই ভাস্কর্যের মূল চরিত্র।
বিমানবন্দর থানার পুলিশ সুত্র জানায়, ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার পরও মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকেরা আগামী ২২ অক্টোবরের সমাবেশের কর্মসুচি প্রত্যাহার করেনি। তারা এখন নতুন দাবি তুলেছে, এখানে হজ মিনার করতে হবে।
মাদ্রাসার কিছু ছাত্র-শিক্ষকের হুমকির মুখে নতি স্বীকার করে ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করতে রাজি নয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিভিল এভিয়েশন)। সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার কমোডর শাকিব ইকবাল খান মজলিস গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, "আমরা চেয়েছিলাম বিমূর্ত টাইপের ভাস্কর্য করতে। কিন্তু যেভাবে চেয়েছিলাম, সেভাবে হচ্ছিল না। তাই এটা আজকের মধ্যেই সরিয়ে ফেলছি। কাল-পরশুর মধ্যে এখানে ফোয়ারা বা উঁচু স্তম্ভ (টাওয়ার) ধরনের কিছু একটা বসানোর সিদ্ধান্ত নেব।"
মাদ্রাসার কিছু ছাত্র-শিক্ষকের আন্দোলনের মুখে ভাস্কর্য সরানো হচ্ছে কি না−এই প্রশ্নের জবাবে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান বলেন, কারও আন্দোলনের মুখে এটা সরানো হচ্ছে না। তিনি বলেন, "কেবল তারাই তো মুসলমান নয়, আমরাও মুসলমান। আমরা নিশ্চয়ই চাইব না, হাজিরা মূর্তি দেখে হজে রওনা হোন।"
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়, জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশমুখে গোলচত্বরে এর আগে একটি বড় ফোয়ারা ছিল। বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহবুব জামিলের উদ্যোগে সৌন্দর্য বর্ধনের অংশ হিসেবে ফোয়ারা ভেঙে সেখানে দেশীয় সংস্কৃতির নিদর্শন হিসেবে বাউলের ভাস্কর্য বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেটা তৈরির জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় ভাস্কর মৃণাল হককে। আগামী ২০ অক্টোবর উদ্বোধন করার কথা ছিল।
মৃণাল হক প্রথম আলোকে বলেন, সিভিল এভিয়েশন ও সড়ক বিভাগের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সাড়ে তিন মাস ধরে লালন শাহকে স্নরণে রেখে ভাস্কর্য তৈরির কাজ করেন। এরপর সেগুলোর কাঠামো ১৫ দিন আগে বিমানবন্দর গোলচত্বরে স্থাপন করে বাকি কাজ করা হচ্ছিল। তিনি বলেন, "এর জন্য সিভিল এভিয়েশন বা সড়ক বিভাগকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছিল না। অর্থায়নের জন্য তারা আমাকে বলেছে স্পন্সর জোগাড় করতে। আমি স্পন্সর জোগাড়ও করেছিলাম।"
মৃণাল হক বলেন, স্থানীয় মসজিদ-মাদ্রাসার লোকদের আপত্তির মুখে বিমানবন্দর থানার পুলিশ ও সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ কয়েক দিন ধরে তাঁকে বলে আসছিল, হুবহু লালনের প্রতিকৃতি না করে যেন বিমূর্ত ধরনের কিছু করা হয়। তারপর সেটাও করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টদের এক কথা, মানুষ আকৃতির কিছু থাকতে পারবে না। এরপর গতকাল তারা এসে হুমকি দেয় যে সরকার না সরালে তারা নিজেরাই ভাস্কর্য উপড়ে ফেলবে। তাই সরকার এখন এটা সরিয়ে নিচ্ছে।"
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খতমে নবুওয়ত আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও ফায়দাবাদ মসজিদের ইমাম মুফতি নুর হোসাইন নুরানীর উদ্যোগে কিছুদিন ধরে আশকোনা, দক্ষিণ খান, গাওয়াইর ও ফায়দাবাদ এলাকার বিভিন্ন মসজিদ ও ছোট ছোট মাদ্রাসায় সভা করে ছাত্র-শিক্ষক ও মুসল্লিদের উত্তেজিত ও সংগঠিত করার চেষ্টা করে। মুফতি নুরানীকে চেয়ারম্যান করে "বিমানবন্দর চত্বর মূর্তি প্রতিরোধ কমিটি" গঠন করা হয়। বিমানবন্দরের সামনের জমেয়া বাবুস সালাম মসজিদ ও মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি মুশতাক হোসেন রতন ও অধ্যক্ষ মাওলানা আনিসুর রহমানকে যথাক্রমে প্রতিরোধ কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব করা হয়। "ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনের" কেন্দ্রবিন্দু করা হয় জামেয়া বাবুস সালাম মসজিদ ও মাদ্রাসাকে।
এর আগে আহমদিয়া বিরোধী উগ্র কর্মসুচির মূল কেন্দ্র হিসেবে এই মাদ্রাসাকে ব্যবহার করা হয়েছিল। বর্তমানে এই মাদ্রাসা ও সংলগ্ন মসজিদের সভাপতি মুশতাক হোসেন রতন সিভিল এভিয়েশনের সাবেক গাড়ি চালক। চাকরিচ্যুত হওয়ার পর তাঁর উদ্যোগে সিভিল এভিয়েশনের জমিতে এই মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। একই কমপ্লেক্সে তারা মার্কেট করে বেশ কিছু দোকানও ভাড়া দেয়।
স্থানীয় দোকানদাররা জানায়, গত সোমবার কয়েক শ মাদ্রাসাছাত্র গোলচত্বরে এসে হুমকি দিয়ে যায় ভাস্কর্য সরিয়ে নিতে। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শখানেক মাদ্রাসাছাত্র এসে আবারও একই হুমকি দেয়। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তারা আবার এসে ভাস্কার্য সরানোর জন্য বাঁধা রশি ধরে টানাটানি করে। তারা সেখানে "বিমানবন্দর গোলচত্বর মূর্তি প্রতিরোধ কমিটি" নামে ব্যানার ঝোলানোর চেষ্টা করে। পুলিশ তা করতে না দিলে পাশের বাবুস সালাম মসজিদের দেয়ালে ব্যানারটি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ওই ব্যানারে লেখা আছে−২১ অক্টোবরের মধ্যে ভাস্কর্য সরিয়ে না দিলে মুফতি নুর হোসাইন নুরানীর নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
বিমানবন্দর থানার পুলিশও দিনভর সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। সন্ধ্যায় বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খান সিরাজুল ইসলাম বলেন, "গত পরশু মাদ্রাসা থেকে ছাত্র-শিক্ষকেরা এসে ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধের দাবি জানালে ওই দিনই কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। গতকাল সকাল থেকে সরানোর কাজ শুরু হয়। তিনি বলেন, তিনি নিজে মুফতি নুর হোসেন নুরানী এবং জামিয়া বাবুস সালাম মসজিদ ও মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি মোশতাক আহমেদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। আমরা তাদের বলেছি, তবু তারা কর্মসুচি প্রত্যাহার করেনি। তারা এখন দাবি করছে, এখানে হজ মিনার স্থাপন করতে হবে।"
এদিকে "মূর্তি প্রতিরোধ কমিটি"র প্যাডে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীর উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন মসজিদের ইমামরা গতকাল মুফতি নুরানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি তাঁদের উদ্দেশে বলেছেন, রক্ত আর লাশের বিনিময়ে হলেও বিমানবন্দর গোলচত্বর থেকে মূর্তি অপসারণ করা হবে। তিনি আজ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কর্মসুচি ঘোষণার কথা জানিয়ে তা ঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য ইমামদের প্রতি আহ্বান জানান। এ সময় মুশতাক হোসেন রতন ও মাওলানা আনিসুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন।

প্রথম আলো, ১৬ অক্টোবর, ২০০৮

BBC Asia-Pacific

CNN.com - Asia