‘একাত্তরে যে সুযোগ হারিয়েছি আবার তা হারানো চলবে না’
- বোস্টারকে মোশতাক
’৭৫ এর ট্র্যাজেডি ॥ মার্কিন দলিলে -৩
অজয় দাশগুপ্ত
- বোস্টারকে মোশতাক
’৭৫ এর ট্র্যাজেডি ॥ মার্কিন দলিলে -৩
অজয় দাশগুপ্ত
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পঞ্চম দিন ২০ আগস্ট বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টার রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ প্রসঙ্গে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে যেসব গোপনীয় বার্তা পাঠানো হয় তা ছিল নিম্নরূপ :
শিরোনাম : নতুন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার (বোস্টার) প্রথম বৈঠক
বোস্টার : আমাকে মাত্র এক ঘণ্টার নোটিশে আজ বিকেল ৩টায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোশতাকের অফিসে ডেকে পাঠানো হয়। এ ভবনে আগে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহ থাকতেন। যদিও আমি রাজনৈতিক কাউন্সিলরকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু রাষ্ট্রপতি একান্ত বৈঠকের অনুরোধ করেন। তিনি প্রথমেই জানতে চাইলেন : আমি কবে ওয়াশিংটন চলে যাচ্ছি [অভ্যুত্থানের আগের সস্পাহে তার সঙ্গে ডিনারে আমি তাকে জানিয়েছিলাম, আমি এ মাসের শেষদিকে সিলেকশন বোর্ডে দায়িত্ব পালনের জন্য চলে যাচ্ছি]। আমি তাকে জানাই, আমি কিছু সময় আগে জেনেছি, আমার ওই দায়িত্ব প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং আমাকে ঢাকাতেই রেখে দেওয়া হচ্ছে। রা®দ্ব্রপতি বলেন, এ খবরে তিনি আনন্দিত হয়েছেন এবং তিনি এটা আশা করছিলেন।
বোস্টার : এরপর রাষ্ট্রপতি আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। বারবার তিনি আমার হাত চেপে ধরছিলেন। দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চাইছিলেন। তিনি বলেন, কী ধরনের সাহায্য প্রয়োজন তার তালিকা তিনি তৈরি করেননি। কিন্তু এটা জোর দিয়ে বলেন, ১৯৭১ সালে যে সুযোগ আমরা হারিয়েছি, আবার তা হারানো চলবে না। এ প্রসঙ্গে তিনি আমার সঙ্গে গত মে মাসে তার আলোচনার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। ১৯৭১ সালে তিনি কলকাতায় যুক্তরাষ্ট্রে কর্মকর্তাদের সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আপসের বিষয়ে চেষ্টা করেছিলেন, যা সফল হয়নি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি তার বিরুদ্ধে ভারতীয় সংবাদপত্রে যে অবন্ধুসুলভ খবর প্রকাশ হচ্ছে তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, দেশে রক্তপাত ছাড়াই পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। কিন্তু যদি ভারত স্থলপথে কিংবা আকাশপথে বিশেষভাবে আকাশপথে যদি অভিযান চালায় তাহলে তিনি প্রতিরক্ষাহীন হয়ে পড়বেন। তিনি বলেন, অসন্তুষ্ট বাঙালিদের শরণার্থী অভ্যর্থনা কেন্দ্রগুলোতে জড়ো করা হচ্ছে বলে তার কাছে খবর রয়েছে এবং তার আশঙ্কা, ১৯৭১ সালে ভারতীয় ও বাঙালিরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে কৌশল অনুসরণ করে সফল হয়েছে এখন সেটাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হতে পারে। আমি তাকে এখানে যা ঘটছে তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে ভারতের বিবৃতির কথা স্মরণ করিয়ে দেই এবং এটাও বলি, ভারত অন্য কোনো পদক্ষেপ নেবে না। তিনি বলেন, তিনি এটা আশা করেন।
বোস্টার : তিনি এরপর আমার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রসঙ্গ তোলেন। আমি তার সরকারের সঙ্গে আমাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখার প্রসঙ্গ তুলে ধরি এবং স্বীকৃতির’ বিষয়টিকে কম গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলি। তিনি বলেন, আপনাদের অবস্থান আমি বুঝি কিন্তু স্বীকৃতির মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্য রয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখা এবং ভারতের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচের জন্য স্বীকৃতি এ মুহূর্তে- ‘আজই’ দেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন। আমি তার এ অবস্থান ওয়াশিংটনে জানিয়ে দেব বলে তাকে জানাই।
তার সরকারের নতুন কার্যক্রম বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৬১ জেলায় পুরনো প্রশাসন ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তিনি বলেন, এ ব্যবস্থা [জেলায় গভর্নর নিয়োগ] একদলীয় বাকশালের অংশ। তিনি বলেন, মাকে হত্যা করে সন্তানকেও হত্যা করতে তিনি সক্ষম হবেন। আমি তার কাছে জানতে চাই, এর দ্বারা তিনি একদলীয় বাকশালের পরিবর্তে বহুদলীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া বোঝাতে চান কি-না। তিনি হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন।
বোস্টার বলেন, আমি তার নতুন দায়িত্বে সাফল্য কামনা করি। আমি তাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হোসেন আলীর সঙ্গে আমাদের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আথারটনের আলোচনা প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলি, আমরা অর্থনৈতিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখব এবং এটা সহায়ক হবে। তিনি উপসংহারে আমাকে যে কোনো সময়ে তার সঙ্গে আমার সাক্ষাতে সমস্যা নেই বলে জানান।
বোস্টারের মন্তব্য : মোশতাকের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে বোস্টার প্রতিবেদনে বলেছেন : আমার কাছে মনে হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নতুন সরকারের প্রতি আমাদের সহানুভূতির মনোভাব প্রকাশের সবচেয়ে কার্যকর ও সহজ উপায় হতে পারে। বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি যুক্তরাষ্ট্র যেসব নীতিগত পরিবর্তন দেখতে চায় তা করতে আগ্রহী বলেই মনে হয়। আমি এ কারণে জরুরিভিত্তিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য অনুরোধ জ্ঞাপন করছি।
কে এই মোশতাক : ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পরপরই ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস ওয়াশিংটনে খন্দকার মোশতাকের পরিচিতি জানায়। এতে বলা হয়, তিনি সবসময়ই মার্কিনপন্থি হিসেবে পরিচিত। ভারতবিরোধী ও সোভিয়েতবিরোধী হিসেবেও তার সুনাম রয়েছে। বেখোটো ও রোগা দেখতে মোশতাককে বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের মানুষ মনে হয় না। শেখ মুজিবের যে ক্যারিশমা সেটাও তার নেই। তিনি তাজউদ্দিন আহমদের বিরোধী। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ হারানোর জন্য তিনি এ প্রভাবশালী নেতা এবং ভারতীয় নেতৃত্বকে দায়ী মনে করেন।
১৯৭২ সালে তিনি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বলেন, তিনি বাংলাদেশে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাত্রাতিরিক্ত প্রভাবের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি সে সময়ে আশা প্রকাশ করেন, যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ও ভারতের প্রভাবের বিরুদ্ধে পাল্টা ভারসাম্য বজায় রাখায় সহায়তা করবে। ১৯৭৪ সালে ঢাকায় রাষ্ট্রদূত বোস্টারের সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাৎকালে তিনি নিজেকে বাংলাদেশ সরকারে মার্কিনপন্থি সদস্য হিসেবে উল্লেখ করেন। সে সময়ে তিনি মুজিবকে আরো সহায়তা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনুরোধ করেন যাতে তিনি বামপন্থার প্রতি ঝুঁকে না পড়েন। ১৯৭৫ সালের ১০ আগস্ট ঢাকায় এক ডিনার পার্টিতে, যেখানে রাষ্ট্রদূত বোস্টার উপস্টি’ত ছিলেন- খন্দকার মোশতাক আহমদ বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন কেউ ভোট দেয় না।’
২২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ইউজেন বোস্টার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে কিছু সময় কথা বলেন। তিনি ১৯৭১ সালে তার যুক্তরাষ্ট্র সফরের উল্লেখ করে বলেন, সে সময় তাকে ৫ বছরের ভিসা দেওয়া হয়েছিল। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সর্বদা কৃতজ্ঞ থাকবেন বলেও জানান। আমি তাকে আমাদের অব্যাহত সাহায্যের কথা জানাই।
বোস্টার ওয়াশিংটনে পাঠানো তার প্রতিবেদনে বলেন, মোশতাকের সঙ্গে যে অনুষ্ঠানে আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে নবনিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম আর সিদ্দিকীও উপষ্থিত ছিলেন। তিনি আমাকে জানান, রাষ্ট্রপতি চাচ্ছেন তিনি যত দ্রুত সম্ভব ওয়াশিংটনে গিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করুন।
বোস্টারের প্রতিবেদনে ২৩ আগস্ট বাংলাদেশের জাতীয় টুপি প্রসঙ্গও স্থান পেয়েছে। তিনি লিখেছেন : এ পর্যন্ত কেবল খন্দকার মোশতাক আহমদই এ টুপি ব্যবহার করতেন। আজকের অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবু সাঈদ চৌধুরী এবং এম আর সিদ্দিকী দু’জনেই যে টুপি পরেছিলেন তা ছিল একেবারে নতুন বানানো। বোঝাই যাচ্ছে, টুপি বানিয়ে বাংলাদেশের দর্জিরা আগামী কিছুদিন ভালো ব্যবসা করবে।
সংগ্রহ করা হয়েছে সমকাল পত্রিকা থেকে।