কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

bdnews24

মুজিব হত্যায় সিআইএ জড়িত নেই প্রচারে মরিয়া মার্কিন দূতাবাসগুলো

৭৫ এর ট্র্যাজেডি মার্কিন দলিলে
অজয় দাশগুপ্ত

১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট নয়াদিল্লিস্থ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতত উইলিয়াম বি স্যাক্সবি ‘বাংলাদেশে অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে ভারতের প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক প্রতিবেদন পেশ করেন ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (যিনি ছিলেন আমেরিকা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত) জে বড়ূয়ার বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে আলোচনা এতে স্থান পেয়েছে। জে বড়ূয়া বলেন, বাংলাদেশের নতুন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতা [স্বাধীনতার পরিবর্তে] চেয়েছিলেন এবং এখন নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালাবেন। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা বলেন, এমনটি ঘটলে তা উপমহাদেশে উত্তেজনা কমাতে পারে এবং তাতে প্রধান তিনটি শক্তিই উপকৃত হবে।

স্পষ্টতই ওই মার্কিন কর্মকর্তা রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে পটপরিবর্তন ঘটেছে তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ব্যক্ত করেন।
মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাকালে জে বড়ূয়া কৌতুক করে বলেন যে, ‘ভারত এবং বাইরের বামপন্থি শক্তি সম্ভবত বাংলাদেশের এ অভ্যুত্থানের সঙ্গে সিআইয়ের যোগসাজশ দেখাতে চেষ্টা করবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সম্প্রতি ঢাকা থেকে ফিরেছেন এমন একজন ভারতীয় কূটনীতিক তাকে আগের সপ্তাহে বলেছেন, বাংলাদেশে কয়েক মাস ধরে অভ্যুত্থানের গুজব শোনা যাচ্ছে।’

ওই সময়ে ভারতে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। জে বড়ূয়া ছিলেন একজন আমলা। তবে রাজনীতিকদের মতামত তার জানা থাকার কথা। কৌতুকছলে তিনি মুজিব হত্যার পেছনে সিআইয়ের সংশ্লিষ্টতার কথা বলেছেন। এ মত কেবলই বামপন্থিদের ছিল, নাকি ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলেও কেউ কেউ তা পোষণ করতেন? প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রশাসনের কি এ মূল্যায়ন ছিল? এসব হচ্ছে ইতিহাসের মুল্যায়নের বিষয়। এখনো এ অধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রামাণ্য দলিলে অনাবিষ্কৃত। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের যেসব দলিল প্রকাশ করেছে তার কিছু অংশ ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার কাটছাঁট করায় অনেক সত্য চিরকাল অন্ধকারে থেকে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক-গবেষক লরেন্স লিফসুলজ মনে করেন, এ ঘটনার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করেছে। তার মতে ওই সময়ে ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বোস্টার বাংলাদেশে সিআইয়ের স্টেশন চিফ পিলিপ চেরির ষড়যন্ত্র বন্ধ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন [ডেইলি স্টার, ১৫ আগস্ট, ২০০৫]।

১৮ আগস্ট নয়াদিল্লিস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতবাস ওয়াশিংটনে যে বার্তা পাঠায় তাতে ১৬ আগস্ট কলকাতায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আয়োজিত দেড় হাজার লোকের একটি মিছিলের প্রসঙ্গ উল্লেখ রয়েছে। মিছিলে মুজিব হত্যার জন্য সিআইয়েকে অভিযুক্ত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্ন তোলে যে, ভারতে জরুরি আইন বলবৎ থাকাকালে কীভাবে মিছিল বের হলো।

২৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস কিসিঞ্জারকে যে বার্তা পাঠায় তাতে বলা হয় : বোম্বের বামপন্থি ‘ক্লারিটি’ সাময়িকী ২৩ আগস্ট সংখ্যায় লিখেছে : ‘সিআইএ বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে।’ এতে লেখা হয় : ‘রাষ্ট্রপতি মুজিব এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে আমেরিকার সহায়তার বিষয়টি এখন এত জোরালোভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে যে, এটা এখন সন্দেহের ঊর্ধ্বে।’

এ নিবন্ধ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত স্যাক্সবির মন্তব্য : ‘ভারতে বাংলাদেশের ঘটনাবলির বিষয়ে সেন্সরশিপ আরোপের কথা বলা হলেও এটা আরো বেশি বেশি করে স্পষ্ট হচ্ছে যে, ভারতের বামপন্থি-সিপিআইপন্থি/মস্কোপন্থিদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হচ্ছে না।’

পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত অমৃতবাজার পত্রিকায় বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের বিষয়ে সিআইয়ের হাত রয়েছে বলে যে অভিমত ছাপা হয় তার প্রতিবাদ জানাতে কলকাতাস্ট’ যুক্তরাষ্ট্র কনস্যুলেটের এক কর্মকর্তা ওই পত্রিকার সম্পাদক এস আর দত্তের কাছে গিয়েছিলেন ২০ আগস্ট।

২১ আগস্ট নয়দিল্লিস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস ওয়াশিংটনে আরো যে প্রতিবেদন পাঠায় তাতে বলা হয় : ২১ আগস্ট ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় ‘মুজিব সাম্রাজ্যবাদের শিকার’ শিরোনামে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে বলা হয় : সিপিআই নেতা ভুপেশ গুপ্ত অভিযোগ করেছেন, মুজিবের হত্যাকারীরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সিআইয়ের মদদপুষ্ট। এ প্রতিবেদনে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রমেশ চন্দ্রের বক্তব্য ছাপা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মুজিব তাকে বাংলাদেশে সিআইয়ের ক্রমবর্ধমান তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত করেছেন।’ রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘গত এপ্রিলে [১৯৭৫] আমি বাংলাদেশ সফর করেছি। সেখানে বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সিআইএ এজেন্টরা সক্রিয় বলে আমি জানতে পেরেছি।’

এসব প্রতিবেদন প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র দূতবাসের কর্মকর্তার মন্তব্য ছিল নিম্নরূপ : ভারতে সেন্সরশিপ বজায় থাকলেও তা যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে সে ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে না।

২১ আগস্ট স্যাক্সবি ওয়াশিংটনে আরেকটি প্রতিবেদন প্রেরণ করেন। এতে বলা হয় : ‘আনন্দবাজার পত্রিকায় বিশিষ্ট সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত ঢাকার অভ্যুত্থান বিষয়ে একটি প্রতিবেদন পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেন। এতে ওই অভ্যুত্থানে সিআইয়ের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার বরুণ সেনগুপ্তের লেখাটি প্রকাশের অনুমতি দেয়নি।’

এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রকে না চটানোর বিষয়ে ভারত সরকারের নতুন নীতি প্রকাশ পেয়েছে বলে ধারণা করা যায়।
স্যাক্সবি ২২ আগস্ট ওয়াশিংটনে জানান : এদিন কলকাতার ইংরেজি দৈনিকগুলোতে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে সিআইয়ের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কিছু লেখা হয়নি। তবে সিপিআইয়ের পত্রিকা কালান্তরে ব্যানার হেডলাইন ছিল ‘মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি’। এতে কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর স্মরণসভার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক সৌগত রায় উত্থাপিত শোক প্রস্তাবে অভ্যুত্থানের পেছনে সিআইয়ের হাত রয়েছে বলে অভিযাগ করা হয়েছে।

১৯ আগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় : যুব কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জন দাস মুন্সি [বর্তমানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী] অভিযোগ করেছেন, মুজিব হত্যাকাণ্ড থেকে প্রমাণ হয় যে, এ উপমহাদেশে সিআইএ এবং চীন কতটা সক্রিয়।

বাংলাদেশে ক্ষমতা পরিবর্তনের পরপরই ভারত সফরে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ঈগলটন। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনাকালে তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেন : ‘আপনি কি বিশ্বাস করেন, সিআইএ বাংলাদেশের ঘটনাবলিতে জড়িত ছিল?’ স্যাক্সবি ওয়াশিংটনে জানান : ঈগলটনের প্রশ্নের উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী পর পর দু’বার বলেছেন, ‘আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো খবর নেই।’

ইন্দিরা গান্ধী বোঝাতে চেয়েছেন, তার কাছে কোনো খবর নেই। কিন্তু তার জানার বাইরেও যে ঘটনা ঘটতে পারে?

রাষ্ট্রদূত ২২ আগস্ট আরো জানিয়েছেন : বাংলাদেশের ঘটনাবলিতে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে আজ কম প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তবে সিপিআইয়ের সাপ্তাহিক প্যাট্রিয়ট এবং দৈনিক কালান্তর ব্যতিক্রম। কলকাতাস্ট’ যুক্তরাষ্ট্র কনসাল অফিসের মি. কর্ন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিবের কাছে কলকাতাস্থ বিভিন্ন সংবাদপত্রে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী সংবাদ ও মতামত প্রকাশের তীব্র প্রতিবাদ জানান।

২২ আগস্ট কর্ন-এর প্রতিবেদনে বলা হয় : ‘আমি মুখ্য সচিবকে জানিয়েছি, যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতর এবং নয়াদিল্লিস্থ’ আমেরিকান দূতাবাস ভারত সরকারকে সম্পূর্ণ আশ্বস্থ করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার কিংবা তার কোনো সংস্থা বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে কোনোভাবেই জড়িত ছিল না। এরপরও এ বিষয়ে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে তাতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাদের এটাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে, এ ধরনের প্রতিবেদন ভারতের সেন্সরশিপ গাইডলাইন লঙ্ঘন করছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বিভিন্ন দেশের মার্কিন দূতাবাসকে ২০ আগস্ট জানান : ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার বক্তব্যে ও সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী যেসব মন্তব্য করা হচ্ছে তাকে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেছেন তাদের পররাষ্ট্র বিষয়ক একজন ডেপুটি সেত্রেক্রটারি। ভারত সরকার এসব প্রচার বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে ওই কর্মকর্তা আশা প্রকাশ করেন।
যুক্তরাষ্ট্র সব সময় সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে সেন্সরশিপ আরোপের বিরুদ্ধে বলছে। কিন্তু বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের বিষয়ে তাদের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছে তা প্রকাশ না করার জন্য তারা বারবার ভারত সরকারের কাছে এ অস্ত্র প্রয়োগের দাবি জানাচ্ছে। তারা এ ধরনের অবস্থান কেন নিয়েছিল? কেন সিআইয়ের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এলেই তা বন্ধ করার জন্য তারা আদাজল খেয়ে লেগেছিল? এসব প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত।

সমকাল ১৮ আগস্ট ২০০৮

BBC Asia-Pacific

CNN.com - Asia