বিশেষ প্রতিনিধি
হাইকোর্ট ঐতিহাসিক জেলহত্যা মামলায় শুধু পলাতক আসামি রিসালদার মোসলেমউদ্দিন ওরফে হিরন খানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন। নিম্ন আদালতের বিচারে মৃত্যুদন্ড পাওয়া অপর দু’জন এবং কারাগারে আটক যাবজ্জীবন কারাদন্ডের চার আসামিকেই খালাস দেওয়া হয়েছে। নিম্ন আদালত তিনজনকে মৃত্যুদন্ড এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছিলেন।
অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় মৃত্যুদন্ড থেকে অব্যাহতি পেয়েছে পলাতক দুই আসামি দফাদার মারফত আলী শাহ এবং এলডি দফাদার মোঃ আবুল হাসেম মৃধা। সন্দেহের সুবিধায় আরো খালাস পেয়েছে লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল (অব.) সৈয়দ শাহরিয়ার রশীদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও লে. কর্নেল (অব.) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ।
কারাগারে বন্দি মাত্র এই চার আসামিই নিম্ন আদালতের দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল। এ মামলায় খালাস পেলেও বঙ্গবন্ধ হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ড হওয়ায় এখনো তাদের কারাগারেই থাকতে হবে। অপরদিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড পাওয়া পলাতক অপর আট আসামির সম্পর্কে হাইকোর্ট কোনো মতামত না দেওয়ায় তাদের দন্ড বহাল রয়েছে বলে আইনজীবীদের ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আতাউর রহমান খান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের চারটি আপিল ও রাষ্ট্রপক্ষের ডেথ রেফারেন্স নিস্পত্তি করে এ রায় দেন। রায়ে আদালত বলেছেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খুনির সঙ্গীদের চিহ্নিত করতে পারেননি। ভুল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
হাইকোর্টের রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আনিসুল হক সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘আইনের নামে এ প্রহসন দুঃখজনক। স্বাধীনতার জন্য যারা রক্ত দিয়েছেন এবং আমরা যারা রক্ত দিতে দেখেছি তারা এ রায়ে মর্মাহত।’
অপরদিকে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দুই আপিলকারীর কৌঁসুলি ব্যারিষ্টার আবদুল্লাহ আল মামুন সমকালকে বলেন, হাইকোর্টের রায়ে প্রমাণ হলো বাংলাদেশে নির্দোষ ব্যক্তি আর ফাঁসিতে ঝুলবে না। এদেশে আইনের শাসন আছে।
তবে অপর এক খালাসপ্রাপ্ত আসামির কৌঁসুলি প্রবীণ আইনজীবী আবদুর রেজাক খান বলেন, এ মামলার তদন্ত যথাযথ হয়নি বলেই প্রকৃত আসামিরা চিহ্নিত হয়নি। একই কারণে কারো বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি।
নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কারাগারে আটক যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত চার আসামির আপিল ও রাষ্ট্রপক্ষের ডেথ রেফারেন্সর ওপর হাইকোর্ট দীর্ঘ ২৬ কার্যদিবস শুনানি গ্রহণ করেন এবং ৮ কার্যদিবসে রায় ঘোষণা শেষ করেন। আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের এ শুনানি দীর্ঘ চার বছর পর গত ১৩ জুলাই হাইকোর্টে শুরু হয়।
নিম্ন আদালত যে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন হাইকোর্টের রায়ে তার আংশিক পরিবর্তন হয়েছে। নিম্ন আদালতের রায়ের ভিত্তি ছিল, ১৫ আগষ্টের পট পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাই একই বছর ২ নভেম্বরে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে পরাজিত হওয়ার মুখে জেলহত্যা ঘটিয়েছে। এ সিদ্ধান্তের জন্য যে তথ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয় তা ছিল, বঙ্গভবন থেকে টেলিফোনে খুনিদের কারাগারে প্রবেশ করতে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ১৫ আগস্টের পর থেকে তারা বঙ্গভবনেই থাকত। কিন্তু হাইকোর্ট খুনিদের কারাগারে প্রবেশ করতে টেলিফোনে দেওয়া নির্দেশের বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস করেননি।
বিশ্বাস না করার ক্ষেত্রে তিনজন সাক্ষীর সাক্ষ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এমন একজন সাক্ষী কর্নেল শাফায়াত জামিল এ মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর মধ্যরাতেই তারা কেন্দ্রীয় টেলিফোন এক্সচেঞ্জের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিজেদের হাতে নিয়েছিলেন।
অপর সাক্ষী রাষ্ট্রপতির তৎকালীন এডিসি কমান্ডার রাব্বানী তার সাক্ষ্যে বলেছেন, ২ নভেম্বর রাত ১১টার দিকেই তিনি ঘুমিয়েছেন। রাত ২টার দিকে রাষ্ট্রপতি তাকে মেসেঞ্জার পাঠিয়ে ডেকে আনেন। তার কক্ষেই টেলিফোন ছিল।
হাইকোর্ট এক্ষেত্রে আসামি পক্ষের কৌঁসুলিদের যুক্তিকে বিবেচনায় নিয়েছেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে, বঙ্গভবনের টেলিফোন সচল থাকলে মেসেঞ্জার পাঠিয়ে এডিসিকে ডেকে আনার প্রয়োজন হতো না।
এ পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে আদালত আরো নিশ্চত হয়েছেন নিহত জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের বোনের ছেলে সেনা কর্মকর্তা আনিসুজ্জামানের সাক্ষ্য থেকে। এ সাক্ষ্যে উল্লেখ রয়েছে, তিনি সে রাতে সদরঘাট এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন। উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে টেলিফোনে কেন্দ্রীয় কারাগারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। একজন হাবিলদার পাঠিয়ে কারাগারে খবর নিয়ে জানতে পারেন বাসা থেকে পাঠানো নাশতা ফেরত গেছে। তিনিই সেদিন কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলামের লাশ গ্রহণ করেছিলেন।
হাইকোর্টের রায়ে এসব সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সেই রাতে বঙ্গভবন থেকে টেলিফোন করে খুনিদের কারাগারে প্রবেশ করতে দেওয়ার তথ্যকে গুরুত্ব দেওয়ার বিপক্ষে মত প্রকাশ করা হয়েছে। আর এ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই পারিপার্শিকতার আলোকে সরাসরি জড়িত ছিলেন না এমনসব অপরাধীকে সন্দেহাতীতভাবে চিহ্নিত করা যায়নি বলে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ প্রকৃত হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছে। কেবল তিনজন সাক্ষী ছাড়া অন্যরা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি দফাদার মারফত আলী ও দফাদার আবুল হাসেম মৃধার বিরুদ্ধে জোরালো কোনো সাক্ষ্য দেয়নি। ফলে প্রত্যক্ষদর্শী নয় এমন তিন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে হত্যা মামলায় কারো মৃত্যুদন্ড দেওয়া যৌক্তিক নয়।
আরো বলা হয়, যেসব সাক্ষী বঙ্গভবন ও কারাগারে উপস্টি’ত ছিলেন বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন তা অবিশ্বাস্য। বঙ্গভবনের যেসব কর্মচারী সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের সাক্ষ্যও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ সে রাতে তারা কেন সেখানে উপস্থিত ছিলেন তারও কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা নেই।
হাইকোর্টের রায়ে আরো বলা হয়েছে, বঙ্গভবন ও কেন্দ্রীয় কারাগারে আগমন ও প্রস্থানের নিবন্ধন বই নিম্ন আদালতে উপস্থাপন করে হত্যাকারীদের বিষয়টি প্রমাণ করা হয়নি। তাছাড়া সেদিন বঙ্গভবনে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের আসা-যাওয়া থেকে তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল তা প্রমাণ হয় না।
আদালত বলেন, আসামিদের চিহ্নিত করার বিষয়টিও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সাক্ষীদের কেউ কেউ বলেছেন কারাগারে প্রবেশ করা সেনাবাহিনীর সদস্যরা খাকি পোশাক পরা ছিল। আবার কেউ বলেছেন কালো পোশাকের কথা। সব সাক্ষীর বক্তব্য ও মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী কর্নেল শাফায়াত জামিলের সাক্ষ্যের অসামঞ্জস্যতা এ মামলায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
হাইকোর্টে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আনিসুল হককে শুনানিতে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন, অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল, অ্যাডভোকেট এসএম রেজাউল করিম, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন মেহেদী এবং অ্যাডভোকেট মোতাহার হোসেন সাজু।
আসামি সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল শাহরিয়ারের পক্ষে সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুর রেজাক খান, মেজর মহিউদ্দিন এবং মেজর বজলুল হুদার পক্ষে ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন, কর্নেল ফারুক রহমানের পক্ষে অ্যাডভোকেট সৈয়দ মিজানুর রহমান ছাড়াও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক তিন আসামি রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী এবং দফাদার আবুল হাসেম মৃধার পক্ষে নিযুক্ত স্টেট ডিফেন্স অ্যাডভোকেট আবদুল হান্নান শুনানি পরিচালনা করেন।
বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের চার প্রধান ব্যক্তিত্বকে খুন করার পরদিন লালবাগ থানায় তৎকালীন কারাপুলিশের ডিআইজি কাজী আবদুল আওয়াল আসামি মোসলেমউদ্দিনসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি পরবর্তীতে সরকারিভাবেই স্থগিত করা হয়। দীর্ঘ ২৩ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর আসামি মোসলেমউদ্দিন, লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
দীর্ঘ ৬ বছরে মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোঃ মতিউর রহমান রায় দেন। রায়ে আদালত মোসলেমউদ্দিন, দফাদার মারফত আলী ও দফাদার আবুল হাসেম মৃধাকে মৃত্যুদন্ড দেন। নিল্ফু আদালতে ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়।
হাইকোর্ট থেকে খালাস পাওয়া চারজন ছাড়াও যাবজ্জীবন পাওয়া অন্যরা হলো লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ (বরখাস্ত), লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (অব.) এমএইচএমবি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব্যাহতি) আহাম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেল্টন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতি) মোঃ কিসমত হোসেন এবং ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার। রায়ের পরপরই দন্ডাদেশপ্রাপ্তরা আপিল করে। ল্যান্সার মহিউদ্দিন গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানোর পর জেল আপিল করে।
নিম্ন আদালতের বিচারে মেজর মোঃ খায়রুজ্জামান, কেএম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে এ হত্যাকান্ডের দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আপিল করবেন
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট আনিসুল হক হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। তিনি সমকালকে বলেন, ‘রায়ে কোর্ট কী লিখবেন সেটা পরীক্ষা করে আইনি প্রতিকার চাইব। রায় সম্পর্কে এ মুহূর্তে শুধু এ কথাই বলতে পারি, আইনের নামে এটা প্রহসন। যা দুঃখজনক। বাস্তবতাকে অস্বীকার করা এই রায় বিচারের প্রতি সাময়িকভাবে হতাশাব্যঞ্জক হলেও শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস আছে। তাই আইনি লড়াই চালিয়ে যাব।’
তিনি আরো বলেন, ‘এর আগেও হাইকোর্টের কিছু কিছু বিচারপতির ব্যবহার আমরা দেখেছি। কিন্তু পরবর্তীতে আপিল বিভাগ তা ঠিক করে দিয়েছেন। এখনো আপিল বিভাগের ওপর আমার বিশ্বাস ও আস্থা রয়েছে।’
সমকাল, ২৯ আগস্ট, ২০০৮