খোলা চোখে
হাসান ফেরদৌস
হাসান ফেরদৌস
ঘটনাগুলো প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ঘটছে, আমাদের চোখের সামনেই। অথচ তা নিয়ে কারও কোনো উদ্বেগ নেই; না সরকারের, না পাড়াপ্রতিবেশীর। আমরা যেন ধরেই নিয়েছি, মেয়েরা, বিশেষত সংখ্যালঘু মেয়েরা, নির্যাতনের শিকার হবে। আক্রান্ত হলে, ধর্ষিত হলে, অথবা খুনের শিকার হলে তাদের কেউ কেউ বড়জোর পত্রিকার ভেতর পাতায় এক কলামের খবর হবে। খুব বেশি হলে কেউ একজন কলাম লিখে খেদোক্তি করবেন। ব্যস, অতটুকুই। অবস্থার কোনোই পরিবর্তন হবে না। বছরের পর বছর এভাবেই চলছে, চলবে।
আমাদের দেশে মেয়েরা এখনো সবচেয়ে কম অধিকারীভোগী। কাগজে-কলমে তাদের যতই সমানাধিকার দিই না কেন, তাদের গলার স্বর অনেক সময়ই বাড়ির বেড়া ডিঙিয়ে বাইরে পৌঁছায় না। নিরঙ্কুশ সংখ্যার হিসেবে তারা দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হলে কী হবে, অধিকার ভোগের বেলায় তারা এখনো প্রান্তবর্তী। শিক্ষায় তারা পিছিয়ে, স্বাস্েথ্য তারা পিছিয়ে, চাকরির ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে। পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটি দেশে পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের আয়ুষ্ককাল কম। বাংলাদেশের মেয়েরা সেসব দেশের একটি। এর ওপর সে মেয়ে যদি ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু হয়, তাহলে কথাই নেই। সংখ্যালঘু নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই কম অধিকারভোগী। তাদের ভেতর আবার সবচেয়ে অরক্ষিত অবস্থায় আছে মেয়েরা।
সবার কথা নয়, আমি আজ শুধু একজনের কথা, একটি সংখ্যালঘু মেয়ের কথা বলতে চাই। আমার চোখে এই একটি মেয়েই যেন দেশের সব পরাজিত, লুন্ঠিত, অবমানিত মেয়েদের প্রতীক। মেয়েটির নাম বিটুনি অশ্রু ডি সিলভা। ঢাকার কাছে কালীগঞ্জের ভাদার্তী গ্রামের মাত্র ১৪ বছর বয়সের স্কুলছাত্রী বিটুনি। প্রথমে সে ধর্ষণের শিকার হয়, পরে হাসপাতালে কিঞ্চিত সুস্থ হলে তাকে গলাটিপে হত্যা করা হয়। এই মেয়েটি ও তার পরিবারকে কী নির্মম সন্ত্রাসের ভেতর দিতে যেতে হয়েছে তা বোঝানোর জন্য পুরো ঘটনাটি আমি যেমন শুনেছি আপনাদের আবার তা শোনাতে চাই। চোখ বন্ধ করে সে ঘটনা আমি দেখতে পাই। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আমার এ লেখা পড়ার সময় আপনারাও একবার চোখ বন্ধ করে তা দেখার চেষ্টা করুন। সম্ভব হলে এ কথা ভাবুন, বিটুনি অচেনা-অজানা এক খ্রিষ্টান মেয়ে নয়। সে আপনার মেয়ে, আপনার বোন, আপনার বন্ধু-কন্যা, বা আপনার মেয়ের ঘনিষ্ঠ সহপাঠী। ঢাকার কোনো কোনো পত্রিকায় মেয়েটির ছবিসহ খবর ছাপা হয়েছে। আমি সন্দেহ করি, আপনারা অনেকেই সে খবর মনোযোগ দিয়ে পড়েননি। পড়লেও এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছেন, সে কথা মনে করার কোনো কারণ নেই। উদ্বিগ্ন হলে এ নিয়ে প্রতিবাদ হতো, রাস্তায় মিছিল নামত, সরকারের কাছে বিচার দাবি করা হতো। কিছুই হয়নি, বরং উল্টো কালীগঞ্জ থানায় এ নিয়ে অভিযোগ করতে গেলে হেনস্তার সম্মুখীন হন বিটুনির বাবা ও মা। বাধ্য হয়ে বিচারের আশায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকায় সাংবাদিকদের কাছে সে ধর্ষণের কথা সবিস্তারে বর্ণনা করতে হয়েছে তাঁদের। রাষ্ট্র তাঁদের রক্ষা করে না, ফলে সাংবাদিকদের কাছেই তারা বিচারের প্রার্থনা করেছেন।
মেয়েটির নাম বিটুনি, যদিও তার একটি পোশাকি নামও আছে। অশ্রু, আমরা তাকে এ নামেই ডাকব। সেদিন ছিল ৩০ এপ্রিল, বুধবার। এ সময়টা এমনিতেই গরম, সে দিন আরও গরম পড়েছিল। রাত তখন এমন কিছু গভীর হয়নি। অশ্রু, স্থানীয় মিশনারি স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী, ঘরেই ছিল। অনুমান করি, স্কুলের পড়া শেষ করে ছোট বোন সেতু, ছোট দুই ভাই জয় ও অর্ণবের সঙ্গে সে হয় আড্ডায় মশগুল ছিল, অথবা টিভি দেখছিল। বাবা কর্মসুত্রে ঢাকায়, ফলে বাসায় অন্য কোনো পুরুষ নেই। মা ছিলেন রান্নাঘরে। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। মা দরজা খুলে দিতেই পিস্তল ঠেকিয়ে চারজন যুবক ঘরে ঢুকে পড়ে। কিছু বোঝার আগেই তারা ঝাপিয়ে পড়ে মধ্যবয়সী সেই মহিলার ওপর। মায়ের আর্ত চিৎকার শুনে অশ্রু ও ভাই-বোনেরা ছুটে আসে। অশ্রুকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে যুবকেরা। একজন চেঁচিয়ে ওঠে, ‘পাইছি, ওরে পাইছি।’ অসহায় অশ্রু ও তার ভাইবোনদের সামনেই মায়ের সম্মানহানী করে ঘাতকের দল। বন্দুকের নল উঁচিয়ে তিন ছেলেমেয়েকে দেখতে বাধ্য করে মায়ের এই লাঞ্ছনা। তারপর বিধ্বস্ত মাকে টেনে ঢোকায় স্মানের ঘরে। এরপর পালাক্রমে তারা ধর্ষণ করে কিশোরী অশ্রুকে। ওই এতটুকুন মেয়ে, মা-বাবার সব আদর যাকে এত দিন আগলে রেখেছিল সব বিপদ থেকে, তাকে শকুনের মতো খুবলে খুবলে খায় চার নরপশু। একসময় শেষ হয় সেই নির্যাতন। যেন এক বিশাল বিজয় অর্জিত হয়েছে, এভাবে ঢেকুর তোলে তারা। মাটিতে নিস্তেজ শুয়ে অশ্রু। চোখের জল আর রক্তের ধারা ততক্ষণে মিলেমিশে একাকার। কিন্তু তারপরও রক্ষা নেই। যাওয়ার আগে, যেন এ নিয়ে টু শব্দটিও না করতে পারে, সে জন্য তার মুখে এক খাবলা বিষ ঢেলে দিয়ে যায়।
লাঞ্ছনার রাত শেষ হয়। ভোর হতে না হতে মা ছুটে যান টেলিফোনে স্বামী জেমসকে ঘটনার কথা খুলে বলতে। তারপর মেয়েকে রিকশায় তুলে সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। যন্ত্রণায় ছটফট করলেও ততক্ষণে জ্ঞান ফিরে এসেছে মেয়েটির। ডাক্তারদের বুঝতে কষ্ট হয় না, কী নির্মম যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। হয়তো সে মরেই যেত, কিন্তু বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা অশ্রুর। সম্ভবত মনের সে বলই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। দুপুর নাগাদ হাসপাতালে এসে হাজির ধর্ষকদের চারজন। তাদের কুকর্ম ইতিমধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে, এ কথা বুঝতে তাদের কষ্ট হয় না। ওষুধ আনতে হাসপাতালের বাইরে অশ্রুর মাকে প্রায় জোর করেই পাঠায় তারা। ওষুধ নিয়ে ফিরে আসতে না আসতেই মা দেখেন তার মেয়ের দেহ নিথর হয়ে পড়ে আছে। ঘাতকের দল অশ্রুকে ধর্ষণ ও বিষ প্রয়োগ করেই সন্তুষ্ট হয়নি, সে যাতে কারও কাছে এ নিয়ে আর কোনো অভিযোগ না তোলে সে জন্য গলাটিপে তাকে হত্যা করেছে।
স্থানীয় থানায় অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিলেন অশ্রুর মা ও বাবা। সেখানে তাঁদের কথায় কেউ কান দেয় না। ইউপি চেয়ারম্যান এ নিয়ে তাদের ভয় দেখান। পাড়াপ্রতিবেশীরাও কেউ পাশে এসে দাঁড়াতে সাহস পায় না। ঘাতকেরা এখনো মুক্ত অবস্থায় বাইরে, নিহত মেয়েটির মা-বাবা বা নিকট আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের যে কেউ তাদের আক্রমণের শিকার হতে পারে, এমন ভয় সর্বক্ষণই আছে। যাদের আশ্রয় ও সাহস দেওয়ার কথা ছিল, তারা কেউ পাশে নেই। তাহলে এখন কোথায়, কার কাছে যাবে অশ্রুর মা-বাবা ও ভাইবোন? ডুবন্ত এসব মানুষেরা কোন বৃক্ষপত্র ধরে বাঁচার চেষ্টা করবে?
এ কেবল এক অশ্রুর কথা। এ রকম আরও কত অশ্রু রয়েছে বাংলাদেশে, তার কোনো খোঁজ কি আমরা রাখি? দিনাজপুরের উপমা দত্ত, মৌলভীবাজারের রুবি রানী, কোম্পানিগঞ্জের সুমি রানী সাহা, পত্রিকার পাতায় এ রকম অনেকেই খবর হয়েছেন। কিন্তু তারা কেউই বিচার পাননি। বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে এমন অনেক সংস্থা বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের তালিকা রাখা শুরু করেছে। আক্রান্ত ও নিহত কিশোরী-যুবতীর সংখ্যা সে তালিকায় ক্রমশই বাড়ছে। সংখ্যাগুরু জনসংখ্যার অন্তর্গত মেয়েরা যে ধর্ষণের শিকার নয়, এ কথা কেউ বলে না। কিন্তু ধর্ষিত মেয়েদের মধ্যে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা যে আনুপাতিক হারে অনেক বেশি, এ কথা জানার জন্য পরিসংখ্যানবিদ হতে হয় না। অথচ তারপরও সবাই যেন আমরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছি। নীরবতার এক ষড়যন্ত্র সর্বত্র। বিদেশে এ নিয়ে কথা বললে অমনি তাদের দেশপ্রেম নিয়ে কথা ওঠে। কই, যারা দেশে বসে এসব দেখেও দেখেন না, শুনেও শোনেন না, তাঁরা কি খুব মস্ত দেশপ্রেমিক?
২.
সম্প্রতি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধাবস্থায় যেকোনো ধরনের নারী নির্যাতনকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছে। সামরিক সংঘর্ষ চলছে এমন পরিস্িথতিতে ধর্ষণকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একটি রণকৌশল হিসেবে ব্যবহারের যে কোনো চেষ্টাই সেই রকম একটি অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরা পাকিস্তানিদের এই কৌশল অবলম্বন করতে দেখেছি। বাঙালি মেয়েদের সম্"ম লুন্ঠন করে সমগ্র বাঙালি জাতিকে অবমাননা ছিল সে রণকৌশলের মূল লক্ষ্য। সাম্প্রতিক সময়ে বসনিয়া, রুয়ান্ডা, কঙ্গো এবং সুদানে আমরা সেই একই রণকৌশলের পুনঃপুন প্রয়োগ দেখেছি। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ১৮৮০ (২০০৮) নম্বর প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে এই প্রথমবারের মতো ধর্ষণ ও সব ধরনের নারী নির্যাতনকে রণকৌশল হিসেবে ব্যবহার আন্তর্জাতিকভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে সাব্যস্ত করল।
কয়েক শ বছর আগেও যুদ্ধের সময় বিজেতা বাহিনী তাদের ন্যায্য পাওয়া হিসেবে মেয়েদের ভোগ করেছে, তাদের দাসী হিসেবে গ্রহণ করেছে অথবা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছে। এ নিয়ে কেউ টু শব্দটিও করেনি। সময় বদলেছে, মানুষ সভ্য হয়েছে, কিন্তু নারীদের প্রতি তাদের আচরণ এখনো বদলায়নি। নারী নির্যাতন, বিশেষত ধর্ষণ কেবল যুদ্ধের সময়ই রণকৌশল হিসেবে ব্যবহূত হয়, এমন নয়। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এর ব্যবহার আমরা সর্বত্র, সবসময়ই দেখেছি। বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। নিম্নবর্ণ বা গরিব শ্রেণীর মানুষের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের ব্যবহার ব্যাপক। কোনো একটি জনগোষ্ঠীকে ভীত-সন্ত্রস্ত রাখতে, তাদের প্রতিবাদের সব পথ রুখতে, ক্ষমতাভোগীদের কাছে ধর্ষণের চেয়ে উত্তম অস্ত্র আর নেই। সংখ্যালঘুরা এমনিতেই গরিব, প্রতিবাদের কন্ঠস্বর তাদের অনুচ্চ, তারপরও কখনো কখনো তারা মাথা নোয়ায় না, দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে তারা বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করে। এহেন প্রান্তবর্তী মানুষদের ঘরবাড়ি লুট করে বা পুড়িয়ে গ্রাম ছাড়া করার পরও যখন তাদের মাথা নোয়ানো যায় না, তখন ব্যবহূত হয় এই মোক্ষম অস্ত্র।
বাংলাদেশে প্রতিটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় আমরা দেখেছি ঘরবাড়ি জবর দখলের পাশাপাশি সংখ্যালঘু মেয়েদের খুঁজে খুঁজে বের করে ধর্ষণ করা হয়েছে। ঘাতকদের লক্ষ্য কেবল তাদের পাশবিক কামনা চরিতার্থ করা নয়, সংখ্যালঘুদের মনে ভীতির এক জগৎ তৈরি করা। ঠিক সেই একই ঘটনা ঘটে নির্বাচনের সময়। সংখ্যালঘুরা যাতে ইচ্ছেমতো তাদের রাজনৈতিক সমর্থন প্রকাশ না করতে পারে, সে জন্য বেছে বেছে সংখ্যালঘু গ্রাম আক্রমণ হয়। বিশেষভাবে আক্রান্ত হয় মেয়েরা। সারা গ্রামের মানুষের চোখের সামনে সংখ্যালঘু মেয়েদের বিবস্ত্র করে দাবড়িয়ে বেড়ানোর ঘটনাও আমাদের অজ্ঞাত নয়। ২০০০ সালের নির্বাচনের পর একটি বিশেষ দলকে সমর্থনের প্রতিশোধ হিসেবে সংখ্যালঘু মেয়েদের ওপর যে নগ্ন আক্রমণ হয়, তার প্রামাণিক প্রতিবেদন ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
ঘোষিত আকারে সামরিক সংঘর্ষ বা জনযুদ্ধ হোক বা না হোক, মেয়েদের বিরুদ্ধে যেখানে যখন পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চলে, সেটাই ক্ষমতাসীনদের হাতে এক রকমের রণকৌশল। এও এক রকম যুদ্ধাবস্থা বৈকি। তাই যেখানে যখনই মেয়েদের ওপর পরিকল্পিত নির্যাতন হয়, তাকেই মানবতার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ বলে বিবেচনা করা উচিত। আইনে সে কথা লেখা থাক বা না থাক, সভ্য মানুষের বিবেকে ও নীতিবোধে সে কথা লেখা আছে। আমরা যদি নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি, তার প্রমাণ হিসেবে প্রতিটি ধর্ষণের অপরাধকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলেই বিবেচনা করা সঙ্গত হবে।
এ ব্যাপারে সরকার বা আইন রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে আমি খুব বেশি কিছু আশা করি না। তারা দুর্বলকে রক্ষার বদলে সবলকে আগলে রাখতেই অধিক ব্যস্ত। বরং অনেক বেশি আশা করি সংবাদপত্রের কাছ থেকে। আর কিছু না হোক অধিকারহীন এই মানুষগুলোর অশ্রুত কন্ঠকে তো তারা তুলে ধরতে পারে। বিটুনি অশ্রুর বেলায় তারা কেউ কেউ সে কাজটি করেছে, তাদের সে জন্য ধন্যবাদ। আমি কোনো কোনো পত্রিকায় অশ্রুর ছবিও দেখেছি। কিন্তু ধর্ষিতা মেয়েটির ছবি প্রকাশের বদলে অনেক বেশি জরুরি যারা ধর্ষণের জন্য অভিযুক্ত কিন্তু এখনো নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায়, তাদের ছবি ছাপানো। কই, এ কাজটি তো আপনারা কেউ এখনো করলেন না?
৩.
১৫ বছর আগে বসনিয়ায় মুসলমান-খ্রিষ্টানদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী জাতিহত্যা ছড়িয়ে পড়ে। সে সময়ে বসনিয়ার একটি গ্রামের একটি ঘটনা। খ্রিষ্টান ও মুসলমান উভয়েই সে গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৯২ সালের মাঝামাঝি তাদের গ্রামে খ্রিষ্টান মিলিশিয়া বাহিনীর উপস্িথতির সুযোগ নিয়ে চারটি খ্রিষ্টান যুবক তাদের প্রতিবেশী এক মুসলমানের বাড়ি আক্রমণ করে বসে। তাদের নজর সে বাড়ির ১৪ বছর বয়সের কিশোরীটির প্রতি।
প্রথমে তারা মেয়েটির বাবা ও মাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে বারান্দায় বসিয়ে রাখল। তারপর পাঁজাকোলা করে টেনে আনল ভয়ে কুঁকড়ে থাকা মেয়েটিকে। সে বাবাকে ডাকল, মাকে ডাকল, আশ্রয় চাইল ঈশ্বরের কাছে। কেউ সাহায্য পাঠাল না। মা-বাবার চোখের সামনে সেই চারজন যুবক প্রায় ২৪ ঘণ্টা বিরতিহীনভাবে ধর্ষণ করল মেয়েটিকে। অসহায় মা-বাবা কৃপা ভিক্ষা করলেন, দেয়ালে মাথা কুটলেন, কারও মনে এতটুকু দয়াও জাগল না। ক্ষত-বিক্ষত সেই মেয়েটি উল্লাসরত যুবক চারজনের চোখের সামনে অবশেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
বসনিয়ার সেই নাম না জানা কিশোরী মেয়ে, আর বাংলাদেশের বিটুনি অশ্রু ডি সিলভা আসলে একই মানুষ। উভয়েই এক অঘোষিত যুদ্ধের শিকার। তাদের জন্য শুধু প্রার্থনা নয়, দরকার প্রতিরোধের প্রবল উচ্চারণ। অশ্রুর মতো আর একটি মেয়েও যেন ধর্ষণের শিকার না হয়, তার জন্য ওঠে দাঁড়ানো দরকার আজ, এখনই।
নিউইয়র্ক, ২৯ জুলাই ২০০৮
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক।
প্রথম আলো, ১ আগস্ট, ২০০৮